এই পৃথিবীর অপার সৌন্দর্যের সবটুকু এখনও আমাদের জানা হয়নি। অনেকটা জানা আবার কিছু জানিও না। যেমন লবণের মরুভূমি সম্পর্কে হয়ত কেউ কেউ জানি, তবে বিস্তারিতভবে নয়।‘সালার দে তুনুপা’ দুনিয়ার সবচেয়ে বড় লবণ মরুভূমি। অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমিও বটে। ‘লবণ মরুভূমি’ নামটা শুনে খটকা লাগতে পারে। কারণ, মরুভূমি মানেই গরম ধূধূ মাঠ, যেখানে বালি আর বালি কিংবা বালি-পাথরে ভরা আদিগন্ত ভূমি। সেই মরুতে ঝড় উঠলে চারপাশ বালিতে একাকার হয়ে যায়। তাহলে লবণের মরুভূমি হয় কিভাবে? তবে কি এখানে ঝড় উঠলে লবণ ওড়ে? না ঠিক তেমনটা নয় বরং এখানে ধুধু বালির বদলে বিশাল দিগন্তের এক লবণ-আয়না তৈরি হয়। ‘সালার দে তুনুপা’ মূলত লবণাক্ত সমতল ভূমি; এককথায় ‘লবণভূমি’। দক্ষিণ পশ্চিম বলিভিয়ার পোটোসের ড্যানিয়েল ক্যাম্পোস প্রদেশের বিশাল আয়নার মতো দেখতে এই লবণ সমভূমি। এটি আন্দিজ পর্বতমালার ভূত্বকের কাছে। এর ব্যাপ্তি ১০,৫৮২ বর্গকিলোমিটার জুড়ে। সমুদ্রতল থেকে এর উচ্চতা ৩৬,৫৬৫ মিটার বা ১,১৯,৯৬৪ ফুট।

বলিভিয়ার আন্দিজ পর্বতমালায় অবস্থিত একটি উচ্চ মালভূমি অঞ্চল হল আলতিপ্লানো। মনে করা হয়, প্রায় ৩০ হাজার থেকে ৪২ হাজার বছর আগে আন্দিজ পর্বতমালার উত্থানের সময় এই লবণভূমি ‘সালার দে তুনুপা’ গঠিত হয়েছিল। এই বয়স অনুমান করা হয় রেডিওকার্বন ডেটিং শাঁস এবং কার্বনেট রিফগুলো পরীক্ষা করে। ভূতাত্ত্বিক ইতিহাসের ধারণায় আলতিপ্লানো মালভূমি অঞ্চলে বিস্তৃত বিভিন্ন প্রাগৈতিহাসিক হ্রদ ছিল। সাধারণ ও লবণাক্ত সেই সব হ্রদের পাশাপাশি লবণাক্ত সমতল ভূমিও ছিল। হ্রদ ও ভূমির মধ্যে ক্রমান্বয়ে রূপান্তরের মাধ্যমে লবণ পলল থেকে এই ‘লবণভূমি’ গঠিত হয়েছিল। পলল বা পলি হলে ভূমিক্ষয়ের মাটির কণা যা বায়ু বা জল দ্বারা পরিবাহিত একটি প্রাকৃতিক উপাদান। এই উপাদান পরিবাহিত হতে হতে একসময় থিতিয়ে জমা হয়ে শিলাস্তর তৈরি করে। সালার দে তুনুপার ভূমিতে মাটির পরিবর্তে সোডিয়ান ক্লোরাইড কণা পলল শিলাস্তর তৈরি করে এই ‘লবণসমভূমি’ তৈরি করেছে।

‘সালার দে তুনুপা’র ভূমি হলে ব্রাইনভূমি। ‘ব্রাইন’ হলো সোডিয়াম ক্লোরাইডের (NaCl) জলীয় দ্রবণ বা লবণ-জলের উচ্চমাত্রার মিশ্রণ। স্বাদু জল বলা হয় যে জলে ০.০৫ শতাংশ লবণের দ্রবণ থাকে। মৃদু লবণাক্ত জলে ০.০৫ থেকে ৩ শতাংশ লবণের দ্রবণ থাকে। লবণাক্ত জলে ৩ থেকে ৫ শতাংশ লবণ দ্রবীভূত থাকে। আর ব্রাইনে থাকে ৫ শতাংশের বেশি লবণের দ্রবণ। লবণভূমি ‘সালার দে তুনুপা’ এই ব্রাইনে গঠিত। এই লবণভূমি সালারে আছে রাসায়নিক মৌল সবচেয়ে হালকা ধাতু লিথিয়াম। বিশ্বের লিথিয়াম মজুদগুলোর ৫০% থেকে ৭০% রয়েছে এখানে। সালার দে তুনুপা কয়েক মিটার লবণের ক্রাস্ট দিয়ে আচ্ছাদিত। এই লবণের আচ্ছাদনে অসাধারণ সমতলতা রয়েছে। এই সমতলতায় বৃষ্টির জলের একটি পাতলা স্তর ভূমিটির ১২৯ কিলোমিটার বা ৮০ মাইল জুড়ে ছড়িয়ে থাকে। ফলে তা বিশ্বের বৃহত্তম আয়নায় রূপ নেয়। লবণের এই বিশাল দিগন্ত-ভূমির জন্যই একে ‘লবণ মরুভূমি’ বলে।

বর্ষাকালে এই লবণাক্ত সমতলভূমিগুলি একটি অগভীর হ্রদে রূপান্তরিত হয় যা আকাশকে নিখুঁতভাবে প্রতিফলিত করে। এই আয়নার প্রভাব অসীমের অবিশ্বাস্য মরীচিকার জন্ম দেয়। এত তীক্ষ্ণ প্রতিফলনের অর্থ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দ্বিগুণ করা এবং একটি নয়, দুটি সূর্যাস্ত! বৃষ্টিতে মরুভূমি এমন এক আয়নাতে পরিণত হয় যেখানে আকাশ প্রতিফলিত হয় যে ভূমি কোথায় শেষ হয় এবং আকাশ কোথায় শুরু হয় তা বলা কঠিন। সালার দে তুনুপায় আয়মারা আদিবাসী জাতির বসবাস। এরা এখানকার লবণ সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করে। ধারণা করা হয়, ১১ কোটি টন লবণ আছে সালার দে তুনুপায়। সালার দে তুনুপার প্রবেশপথে রয়েছে একটি রেলগাড়ির সমাধি। একসময় এসব ট্রেনের মাধ্যমে এখান থেকে লবণ উত্তোলন ও পাচার হতো। পরে স্থানীয় আদিবাসীরা বিদ্রোহ করে আটকে দেয় ট্রেন। অবশেষে ট্রেনের পরিবহণ বন্ধ করে দেয়া হয়। আর পরিত্যক্ত ওইসব ট্রেনই এখন ‘ট্রেন সমাধি’ নামে ঐহিত্য পেয়েছে।

একটি প্রাচীন আইমারান কিংবদন্তি অনুসারে, লবণাক্ত ভূমির চারপাশের পাহাড়, যাদের নাম কুসিনা কুস্কু এবং টুনুপা, একসময় বিশাল মানুষ ছিল। টুনুপা এবং কুস্কু বিবাহিত ছিলেন এবং যখন কুসিনার জন্য কুস্কু তার স্ত্রীকে ত্যাগ করেন, তখন টুনুপা কান্না থামাতে পারেননি এবং তার অশ্রু লবণাক্ত ভূমি তৈরি করে। লবণের পিরামিড দিয়ে বিছিয়ে থাকা, সালার দে উয়ুনি হল লবণের স্ফটিক প্রকৃতির কারণে সৃষ্ট ষড়ভুজাকার রেখার একটি অন্তহীন ক্রিস-ক্রস। শুধু তাই নয়, এই বিশাল লবণ মরুভূমির মাঝখানে সম্পূর্ণ লবণ দিয়ে তৈরি একটি হোটেল রয়েছে! লবণের ইট এবং মর্টার ব্যবহার করে নির্মিত, হোটেলের ভিতরের সবকিছু, যার মধ্যে চেয়ার, টেবিল এবং বনাও রয়েছে, লবণ দিয়ে তৈরি। হোটেল প্লায়া ব্লাঙ্কায় সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে খুব বেশি কিছু নেই, তবে রাতের আকাশের অসাধারণ দৃশ্যের সাথে কিছুটা শান্তি এবং নিস্তব্ধতা উপভোগ করার জন্য এটি একটি দুর্দান্ত জায়গা। পর্যটকদের জন্যও সালার দে তুনুপা একটি অপূর্ব সুন্দর কেন্দ্র। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা।
