কলকাতা ব্যুরো: মঙ্গলবার বেলার দিকে ভিডিয়ো পোস্ট করে কেকে-এর গানের সমালোচনা করেছিলেন। সে খবর ছড়াতেই তুমুল শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। এরপর মঙ্গলবার রাতে কলকাতাতেই কেকে-র আকস্মিক মৃত্যু। যা আগুনে ঘি ঢালে। তারপর থেকেই সকলের রাগ, ক্ষোভের মুখে রূপঙ্কর। এমনকি এবার নাকি আসছে খুনের হুমকিও। সেই অভিযোগ নিয়েই এবার পুলিশের দ্বারস্থ হলেন রূপঙ্কর বাগচী ও তাঁর স্ত্রী চৈতালী লাহিড়ী।
অভিযোগ পাওয়ার পরই টালা থানার পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। রূপঙ্কর বাগচীর বাড়িতে টালা থানা থেকে পুলিস পৌঁছয়। তাঁরা বাড়ির চারপাশের পরিস্থিতি ঘুরে দেখেন। পাশাপাশি যে সমস্ত ফোন থেকে হুমকি আসছে, সেই ফোন নম্বরগুলিও সংগ্রহ করেছে পুলিস। তার সিডিআর ও এসডিআর অ্যানালিসিস করে কারা এই হুমকি ফোনের নেপথ্যে আছে, তাঁদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন বলে দাবি কলকাতা পুলিসের।
উল্লেখ্য, মঙ্গলবার নজরুল মঞ্চে গুরুদাস কলেজের অনুষ্ঠানের পর আচমকাই অসুস্থ হয়ে মৃত্যু হয়ে পড়েন কেকে। তারপরই জনরোষ গিয়ে পড়েছে রূপঙ্করের উপরে। সোশ্যাল মিডিয়া ভাসছে কটাক্ষের বন্যায়। একদিকে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে বাংলার সঙ্গীত মহল। তবে ইন্ডাস্ট্রির কেউ কেউ অবশ্য রূপঙ্করের পাশেও দাঁড়িয়েছেন। ইতিমধ্যেই ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী রাখতে বাধ্য হয়েছেন রূপঙ্কর।
তবে ঘটনার সুত্রপাত সোমবার। জানা গিয়েছে, সোমবারও নজরুল মঞ্চে বিবেকানন্দ কলেজের অনুষ্ঠানে গান গাইতে এসেছিলেন বলিউডের তারকা গায়ক কেকে। নেটমাধ্যমে তাঁকে নিয়ে বাংলার অনুরাগীদের উল্লাস চোখে বিঁধেছে জাতীয় পুরস্কারজয়ী গায়ক রূপঙ্কর বাগচীর এবং সেই জায়গা থেকেই তিনি মন্তব্য করেন, কেকে সত্যিই খুব ভাল গায়ক। কিন্তু ওঁর লাইভ ভিডিয়ো দেখার পরে উপলব্ধি হল, কেকে জাতীয় স্তরে যে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন বাংলার শিল্পীরা কোনও অংশে কম নন। আমি, রূপম ইসলাম, অনুপম রায়, ইমন চক্রবর্তী, সোমলতা আচার্য— আমরা সবাই কেকের থেকে ভাল গান গাই!
রূপঙ্কর আরও বলেন, KK- KK-KK, কে হু ইজ কেকে! আমরা যে কোনও কের থেকে ভালো গায়। আমি যে গায়কদের নাম নিলাম তাঁরা KK-র থেকে অনেক ভালো।
এই পোস্টের পর সঙ্গে সঙ্গে তেড়ে এসেছেন নেট ব্যবহারকারীরা। তাঁদের মতে, আপনার প্রতি যাঁদের যে শ্রদ্ধাটুকু আছে সেটুকুও হারাবেন। ভাল থাকুন সুস্থ হয়ে উঠুন। কেউ তাঁকে ‘হিংসুটে’ তকমাও দিয়েছেন! লিখেছেন, ‘মিস্টার বাগচী, আপনাকে বলছি। শুনুন। সবার প্রথমে একটা দশমিক বসান, তার পরে একশটা শূন্য বসিয়ে একটা এক লিখুন। তারপরে একটা পার্সেন্টেজ চিহ্ন বসান। যে সংখ্যাটা দাঁড়াল, শতকরা সেই ভাগটুকু যদি আপনার যোগ্যতা থাকত একজন শিল্পী হওয়ার, তা হলে আপনি এই কথাগুলো বলতে পারতেন না।
জাতীয় পুরস্কারজয়ী শিল্পী ইমন চক্রবর্তী বলেছেন, লাইভে রূপঙ্করদা আমার নাম নিয়েছেন। সেটা সম্পূর্ণ ওঁর ব্যাপার। এ নিয়ে আমার কিচ্ছু বলাই সাজে না। কিন্তু রূপঙ্করদার এই ধরনের বক্তব্যে আমি যথেষ্ট বিব্রত। ইমনের আরও দাবি, অত্যন্ত ভদ্র, ভালো মনের মানুষ ছিলেন। দিন কয়েক আগের অনুষ্ঠানে ওঁর আগে আমি গান গেয়েছি। দিলখোলা প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁকে এ ভাবে অকারণে ছোট করা বোধহয় ঠিক হয়নি। গায়িকার মতে, শিল্পীদের মধ্যে পারস্পরিক সৌজন্য, সৌহার্দ্য, শ্রদ্ধা তো থাকবেই! একই সঙ্গে ইমন এও বলেছেন, কেকে যদি এ ভাবে না-ও চলে যেতেন, তা হলেও আমি রূপঙ্করদার বক্তব্যে এতটাই বিব্রত হতাম।
তবে নজরুল মঞ্চে বাঁধভাঙা ভিড়ে অনুষ্ঠান করা যে কতটা কষ্টকর, সেই অভিজ্ঞতাই শেয়ার করেছেন সঙ্গীত শিল্পী রুপম ইসলাম। তাঁর মতে, এসি বন্ধ হয়ে যায়। মঞ্চেও সার বেঁধে দর্শক দাঁড়িয়ে থাকলে দম নেওয়ার ফাঁকটুকুও থাকে না। অভ্যেস না থাকলে এমন পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠান করা মুশকিল। কতটা শারীরিক কষ্ট সহ্য করে তাঁদের পারফর্ম করতে হয় সেই অভিজ্ঞতার কথা জানান তিনি। পাশাপাশি একই সুপারহিট অ্যালবাম জন্নত-এ কাজ করা সত্ত্বেও তাঁদের আলাপ হয়নি বলে জানান তিনি। তবে আলাপ না হওয়ার আক্ষেপ ঝরে পড়েছে রুপমের ফেসবুক পোস্টে। ফেসবুকে তিনি লেখেন, খুব কম শিল্পীর গান চার ফর্ম্যাটে সংগ্রহ করে শুনেছি। ক্যাসেট, সিডি, ডিজিট্যাল এবং সব শেষে এল পি রেকর্ড। ‘পল’ অ্যালবামটি মারাত্মক এফেক্ট ফেলেছিল তাঁর জীবনে। সেই অ্যালবামের সব কিছুই সংগ্রহে রয়েছে বলেও জানান তিনি। ওই অ্যালবামের একটি গানও একবার ফসিলসের হয়ে কভার করেছিলেন।
অভিনেত্রী রূপাঞ্জনা মিত্র নিজের ফেসবুকে লেখেন, “শেম অন ইউ রূপঙ্কর বাগচী, আপনি নিজের মনের সংকীর্ণতাকে সরান তারপক কেকে এর সঙ্গে তুলনা টানবেন নিজের, আপনার জাতীয় পুরস্কার পাওয়াটাই কাল, আগে বড় মনের মানুষ হন বাংলার শিল্পী হিসেবে কতটা ছোট মনের পরিচয় দিলেন, আগে বড় মনের মানুষ হোন, আপনাকে ধিক্কার! কেকে তাঁর গয়কী দিয়ে আমাদের মন জয় করেছেন।এভাবে তাঁকে ছোট করার অধিকার কেউ দেয়নি আপনাকে।”
ক্ষুব্ধ অভিনেতা ভাস্বর চট্টোপাধ্যায়ও। রূপঙ্করকে দিলীপ ঘোষের সঙ্গে তুলনা করলেন অভিনেতা। ফেসবুক কটাক্ষ করে লিখলেন এ তুমি কেমন তুমি কেকে’র গানকে হিংসে কর… ভাস্বর এই বিষয়ে দু’টি পোস্ট করেছেন। আরেক পরিচালক অরিন্দম ভট্টাচার্য রূপঙ্করকে ব্যান করার কথা লেখেন ফেসবুকে।
তবে কোন অনুভূতি থেকে হঠাৎ এমন ধরনের মন্তব্য করলেন রূপঙ্কর? কেকে-এর প্রতি কেনই বা এত রাগ তাঁর? রূপঙ্করের কথায়, কেকে-এর প্রতি আমার কোনও রাগ নেই। শুধু কেকে কেন, অন্য ভাষার কোনও গায়ক বা গায়িকার প্রতিই আমার কোনও অশ্রদ্ধা নেই। আমার অনুরোধটুকুই কেউ বোঝেননি। ফেসবুকে আমি বলেছি, আপনারা মুম্বইকে নিয়ে এত মাতামাতি করে যাচ্ছেন। দক্ষিণ ভারতকে দেখুন, পঞ্জাবকে দেখে শিখুন, ওড়িশাকে দেখুন। বাঙালি হন। বাঙালি হন প্লিজ!
তিনি আরও বলেন, কেকের প্রয়াণে তিনি নিজেও শোকস্তব্ধ। তবে নেটাগরিকরা এখন এসব যুক্তি মানতে নারাজ। সবাই এখন রূপঙ্করকেই ধিক্কার জানাচ্ছেন।