এই পৃথিবীর প্রতিটি জীবন যেমন আলাদা তেমনি তাদের বেঁচে থাকার গল্পও ভিন্ন। বেঁচে থাকার সব গল্পের আড়ালেই থাকে সংগ্রাম কিন্তু প্রতিটি সংগ্রাম যে সফল নয় তা আমরা সবাই জানি। তবে যে কোনওগল্পকে সফল হয়ে উঠতে কার্যত কঠিন থেকে কঠিনতর লড়াই চালিয়ে যেতে হয়। সেই বাস্তবতাই সফল গল্পটিকে নানাদিক নানা মাত্রা দিয়ে সমৃদ্ধ করে তোলে। জীবন সংগ্রামের সেই গল্প শুনতে শুনতেই আমরা সফল ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠি, তার জন্য গৌরব অনুভব করি। আসলে কীর্তিময় মানুষের জনপ্রিয়তার আড়ালের গল্পটিও সেই একই সুরে বাঁধা। একটার পর একটা প্রতিকূল পরিস্থিতি পার হয়ে এসেই তিনি ইতিহাসের পাতায় তাঁর কৃতিত্বের কাহিনি লিখে যান।
‘কিং অব রক’ এলভিস প্রিসলি যে ‘কান্ট্রি’ দিয়ে শুরু করে পরে ‘রিদম অ্যান্ড ব্লুস’ তারপর ‘রক এন রোল’ ( Rock n Role )-এর ছন্দে আর মূর্ছনায় দু’দশক ধরে গোটা দুনিয়াকে মাতালেন সেই সাফল্যের গল্পও তো সেই সুরেরই অনুরণন। কেবলমাত্র রক অ্যান্ড রোলের রাজা এলভিস প্রিসলির নিজের সময় নয়, তিনি পরবর্তী প্রজন্মকেও প্রভাবিত করেছেন নানা দিক দিয়ে। তাঁর গান তো আছেই, সেই সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিত্বের আবেদন, পোশাক, স্টাইল সব মিলিয়ে এলভিস ছিলেন ষাট আর সত্তরের দশকের প্রতিনিধি।

গরিব সংসারের ছেলে এলভিস এক সময়জীবিকার জন্য ট্রাক চালিয়েছেন। আবার তার সঙ্গে গানও গেয়েছেন।ছেলেবেলায় সেই যে বাবা-মার সঙ্গে চার্চে গিয়ে গান গাইতেন সেটা মনের ভিতরে যত্নে আগলে রেখেছিলেন। একদিন নেহাত শখের বসেই মেমফিস স্টুডিওতে গিয়ে পকেটের পয়সা খরচা করে কয়েকটি গান রেকর্ড করে ফেলেন নিজেরমাকে জন্মদিনের উপহার হিসেবে দেওয়ার জন্য।
এর ঠিক এক বছর বাদে সেই মেমফিস স্টুডিওর মালিক স্যাম ফিলিপস এলভিসকে আচমকা ডেকে পাঠালেন। তিনিও এলভিসকে দিয়ে কয়েকটি গান রেকর্ড করালেন। সেই গানগুলির মধ্যে ছিল কান্ট্রি, রিদম অ্যান্ড ব্লুজ। এলভিস একের পর এক সেই সব গান গেয়ে স্টুডিওর মানুষদের একেবারে সম্মোহিত করে ফেলেন। ব্যাস এখান থেকেই শুরু হয়ে গেল এলভিসের জীবনের নতুন অধ্যায়।
জীবনে প্রথম শো পেলেন কিন্তু শো-এর শেষে সেই শো-ম্যানেজার জিমি ড্যানি এলভিসকে চাকরিচ্যুত করলেন। জানা যায় ড্যানি নাকি এলভিসকে বলেছিলেন, ‘তুমি একজন নন-পারফর্মার, গানের বদলে তুমি বরং ট্রাক চালানো শিখে নাও। উন্নতি করতে পারবে’। এই সব কথাবার্তা শুনতে শুনতেই এলভিস তাঁর সঙ্গীত জীবনের পরবর্তী অধ্যায়গুলি লিখতে শুরু করে দিলেন। গানে গানে মাতিয়ে দিলেন গোটা সঙ্গীতবিশ্ব।
এলভিস যে সঙ্গীতকে বিশ্বের দরবারে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেনতা হল- রক এন্ড রোল, আর তার প্রথম জনপ্রিয় গানটি ছিল- ‘লাভ মি টেন্ডার’। প্রথম একক অ্যালবাম ‘হার্ট ব্রেক হোটেল’ মুক্তির আলো দেখার পরই মাত্র কয়েক ধাপেই বদলে যায় তার জীবন প্রবাহ। এলভিস একটি ব্যান্ডও তৈরি করেছিলেন- ‘দ্য ব্লু মুন বয়েজ’।
তখনও আমেরিকার জীবনে ও সংস্কৃতিতে সাদা ও কালোদের মধ্যে ফারাক যথেষ্ট বিদ্যমান। এলভিস প্রথম সেই সাদা-কালো ফারাক বা দূরত্বকে গানের মধ্যে দিয়ে এক সুতোয় বাঁধতে চেষ্টা করেন। জন্ম থেকে বেড়ে ওঠার সময় এলভিস আমেরিকার বর্ণবাদকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন।পাশাপাশি যে সব গান, তার গায়কী এলভিস তাঁর শৈশব-কৈশোর থেকে শুনে এসেছেন, সেগুলি তাঁর ভিতরে যত্নে লালিত হয়েছিল। আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চল যেখানে এলভিস বেড়ে উঠেছেন সেখানকার শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের সামনে এলভিস ব্ল্যাক মিউজিককে বেশি বেশি করে তুলে ধরেন। বয়স্ক শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানরা বরাবরই বর্ণবাদী। তরুন শ্বেতাঙ্গদের কাছে এলভিস পৌঁছে যান তাঁর গান, তাঁর স্টাইলএবং স্টেজ পারফরম্যান্স দিয়ে তিনি কিশোর থেকে তরুনদের মন ছুঁয়ে ফেলেন। এলভিস যত কিশোর-তরুনদের কাছাকাছি যাচ্ছিলেন ততই আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ সমাজ, মিডিয়া, চার্চ এলভিসের কঠোর সমালোচনা করতে থাকে।

আসলে এলভিস বর্ণবাদী এবং রক্ষণশীল আমেরিকান শ্বেতাঙ্গ সমাজের ওপর আঘাত করেছিলেন। বয়স্ক শ্বেতাঙ্গরা এলভিসকে যেমন ঘৃণা করত, তরুন সমাজ ততটাই ভালবাসত। তরুনদের কাছে এলভিস হয়ে উঠেছিলেন স্বাধীনতার প্রতীক, নিজের মতো করে চলার অনুপ্রেরণা। মেয়েরা এলভিস বলতে পাগল, আর সব ছেলেরা চাইত এলভিসের মত হতে!এলভিসের গানের মধ্যে দিয়ে সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটে যায়। সামাজিক পরিবর্তনঘটে শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান তরুনদের মধ্যে। আমেরিকায় সেই সময় বর্ণবাদ ছিল ঠিকই কিন্তু অর্থনৈতিক ভাবে দেশটি ক্রমাগত এগিয়ে চলছিল। আমেরিকার তরুন সমাজ সেই সময় থেকেই তাদের বাবা-মার পুরোনো ধ্যান ধারণা মেনে চলতে রাজি হচ্ছিল না। তারা নিজেদের স্টাইল, নিজেদের জীবন যাপনের ধরণ ধারণ নিজেরাই ঠিক করে নিচ্ছিল। নিজেদের মতামত প্রকাশ করছিল কোনও দ্বিধা না রেখেই। আমেরিকার তরুনদের মধ্যে এই স্বাধীনচেতা মনোভাব ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন এলভিস তাঁর গান ও লাইফস্টাইল দিয়ে।
এরপর শুধু আমেরিকা নয়, বিশ্বের তরুনদের আইকন হয়ে ওঠেন এলভিস। মেয়েরা এলভিস প্রিসলি বলতে পাগল। তারা হুমড়ি খেয়ে পড়ত একবার দেখা করবার জন্য। কাছাকাছি যারা পৌঁছেছিল, তারা প্রিসলির জামাকাপড় টেনে ছিঁড়ে ফেলছিল। আর যারা তার কাছে পৌঁছাতে পারেনি, তারা প্রিসলির সাদা লিঙ্কন কন্টিনেন্টাল গাড়ির শরীরজুড়ে তাদের ফোন নাম্বার লিখে দিয়ে যেত। স্টেজ, টেলিভিশন, সিনেমা সর্বত্র এলভিসের প্রভাব ছিল সর্বগ্রাসী। ৩১টি সিনেমায় অভিনয় করেছেন তিনি।
1 Comment
কিং অফ দি রক এলভিস প্রেসলি রক অ্যান্ড রোল দিয়ে দুনিয়াটা বদলে দিয়েছিলেন। অন্তত গত শতকের ষাট-সত্তর দশক তরুণরা নিজেদের মতো করে ভেবেছিল,
স্বাধীনভাবে ভাবতে শিখেছিল তাঁরই প্রভাবে…