মায়া মধ্য আমেরিকার অন্যতম প্রাচীন সভ্যতা। মায়া থেকে প্রায় ৮০০ কিলোমিটার পশ্চিমে একটি জাতি বাস করত তাদের নাম ছিল আজটেক। খ্রিস্টীয় ১৩৪৫ থেকে ১৫২১ শতাব্দীর মধ্যে নতুন সভ্যতা আজটেক সভ্যতার উৎপত্তি হয়েছিল। আজটেক জাতি মধ্য আমেরিকার স্থানীয় বাসিন্দা ছিল না বলেই ধারণা করা হয়। আজটেকরা ছিল উত্তর থেকে আসা শিকারি জনগোষ্ঠী। খ্রিস্টীয় ১৩ শতকে তারা মেক্সিকোর জলাশয় অঞ্চলের একটি দ্বীপে আধিপত্য বিস্তার করে। এরপর ধারাবাহিকভাবে তারা ওই অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। বর্তমান মেক্সিকো সিটি যেখানে, সেখানেই প্রাচীন আজটেক সভ্যতার যাত্রা শুরু হয়। যার বিস্তৃতি ছিল উত্তর আমেরিকার বেশির ভাগ অংশজুড়ে। কৃষিকাজের মাধ্যমে আজটেক সভ্যতার প্রসার ঘটে।
যতদূর জানা যায়, আজটেকের শাসকরা ছিল অত্যন্ত স্বেচ্ছাচারী। টেনোচিটিলান ছিল আজটেকের রাজধানী, যা আজটেক সাম্রাজ্যের প্রধান প্রশাসনিক ও ধর্মীয় কেন্দ্র ছিল। টিনোচ ছিলেন আজটেকদের প্রথম রাজা। সভ্যতার শুরুতে আজটেক যোদ্ধারা তাদের প্রতিবেশী রাজ্যগুলিকে দখল করতে সক্ষম হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, ওই সময় আজটেক শাসক দ্বিতীয় মোটিচুচ্চোমার পুরো মেক্সিকো অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। তিনি তার আদর্শ ও ধর্ম নাগরিকদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। নাগরিকেরা দেবতাকে মানতেন যদিও সভ্যতার শেষের দিকে আজটেক জাতি নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক কলহ আর যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। তবে আজটেক সভ্যতার পতন ঘটে স্পেনীয়দের আক্রমণে। সৃজনশীল ও উন্নত সংস্কৃতির ধারক হিসেবে প্রায় ৪৫০ বছর নিজেদের সভ্যতা টিকিয়ে রাখতে পেরেছিল আজটেকরা।
অ্যাজটেকরা কুখ্যাত হয়েছিল তাদের রক্তপাত এবং বর্বরতার জন্য। নরবলি অ্যাজটেক সভ্যতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় প্রথা ছিল। অ্যাজটেকদের মতে, দেবতাদের তুষ্ট করা এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য তা করা হত। বিশেষত সূর্য দেবতা হুইতজিলোপোচটলিকে শক্তি জোগানোর জন্য মানুষের রক্ত ও প্রাণ উৎসর্গ করা হত। সাধারণত যুদ্ধবন্দি বা দাসদের বলির জন্য নির্বাচন করা হত এবং তাদের হৃৎপিন্ড বের করে দেবতাদের উদ্দেশে উৎসর্গ করা হত। অ্যাজটেকরা বিশ্বাস করত, যদি দেবতাদের যথাযথ বলিদান দেওয়া না হয় তবে সূর্যোদয় বন্ধ হয়ে যাবে এবং পৃথিবীতে ধ্বংস নেমে আসবে। এই ধর্মীয় বিশ্বাস এবং রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের জন্য অ্যাজটেকরা প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার মানুষকে বলি দিত এবং নতুন মন্দির নির্মাণের সময় এই সংখ্যা চার গুণ বেড়ে যেত। জীবিত অবস্থায় হৃদয় বের করা, চামড়া ছাড়ানো, অঙ্গ ছিন্নভিন্ন করা- এসবই তাদের ধর্মীয় রীতির অংশ ছিল। শুধু তাই নয়, একসময় করের মধ্যে মানব বলিদানও অন্তর্ভুক্ত ছিল। কখনো কখনো মহিলা ও শিশুদের বলিদান দেওয়া হত। তবে বেশির ভাগ শিকার ছিল আশপাশের রাজ্যের যুদ্ধবন্দিরা।
বেশির ভাগ সময় বন্দিদের তেনোচটিটলান শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত টেম্পলো মায়োর (মহান মন্দির) চূড়ায় বলি দেওয়া হত। আধুনিক গবেষকরা এই প্রথাকে কেবলমাত্র বর্বর আচরণ হিসেবে দেখেন না, তারা বলেন, এই ধরনের ধর্মীয় বিশ্বাস সামাজিক কাঠামোর অংশ ছিল, যা তাদের সভ্যতার অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করেছিল। ১৫২১ সালে আজটেক দখল করেন এরনান কর্তেজ। রাজধানী তেনোশতিতলানে পৌঁছানোর পর এই স্প্যানিশ যোদ্ধা ও তাঁর সহযাত্রীরা দেখতে পান, টেমপ্লো মেয়রের (তখনকার প্রধান মন্দির) পুরোহিত ধারালো অস্ত্র দিয়ে একজনের বুক চিরে হৃৎপিণ্ড বের করে ফেলেছেন। তারপর ধুকধুক করতে থাকা হৃৎপিণ্ডটা দেবতার কাছে তুলে ধরা হয় অর্ঘ্য হিসেবে। পরে বলি দেওয়া মানুষটির দেহ মন্দিরের উঁচু বেদি থেকে নিচে ফেলে দেওয়া হয়। কোথাও কোথাও বলা হয়, মন্দিরের একটি অংশ তৈরি করা হয়েছিল মানুষের খুলি দিয়ে!
কয়েকশো বছর পর অনেক ইতিহাসবিদ এই বয়ানকে নাকচ করে দিয়েছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, আজটেক সম্রাট মকতেজুমার হত্যাকাণ্ড এবং তার কারণে সভ্যতা ধ্বংস প্রমাণ করতেই স্প্যানিশরা এইসব গল্প ফেঁদেছে। কিন্তু তাঁদের সেই দাবি ধোপে টেকেনি; কারণ, ২০১৫ ও ২০১৮ সালে মেক্সিকো সিটির টেমপ্লো মেয়র মন্দির এলাকায় প্রত্নতাত্ত্বিক খনন থেকে মানুষের খুলি বেরিয়েছিল। স্প্যানিশ ইতিহাসবিদ দিয়েগো দুরান দাবি করেন, এই মন্দির উদ্বোধনের সময় ৮০ হাজার ৪০০ নারী, পুরুষ, শিশুকে বলি দেওয়া হয়েছিল। মন্দিরের ম্যুরাল ও খোদাই করা নকশা থেকে তিনি এই তথ্য উদ্ধার করেন। আমেরিকার টুলেন ইউনিভার্সিটির নৃতাত্ত্বিক জন ভেরানোর মতে, আধ্যাত্মিকতার জায়গা থেকে আজটেকরা এই বর্বর আচার পালন করত। ছোট–বড় নরবলির আয়োজন হত আজটেক দিনপঞ্জি অনুসারে। তিনি আরও জানান, খরা ও মন্বন্তর দূর করার উদ্দেশ্যই মন্দিরে নিয়মিত এই বলি হত। আর আজটেকদের বিশ্বাস ছিল, সূর্যদেবতা অন্ধকারের সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করে যাচ্ছেন। এই লড়াইয়ে সূর্য যদি হেরে যায়, তাহলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই সূর্যের হাত শক্তিশালী করতে তাকে উপহার হিসেবে দিতে হবে মানুষের রক্ত ও হৃৎপিণ্ড!
১৫ থেকে ১৬ শতক পর্যন্ত আজটেক সাম্রাজ্য বিস্তৃত হওয়ার পেছনেও এই নরবলির ভূমিকা আছে। এই বলির মাধ্যমে জনগণকে ভয় দেখানো হত। ভয়ে মানুষ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে কোনো প্রশ্ন তুলত না। প্রত্নখননে পাওয়া খুলিগুলোর ডিএনএ পরীক্ষা করে জানা গেছে, নিহত বেশির ভাগ মানুষই বাইরে থেকে আসা। ধারণা করা হয়, তাদের বেশির ভাগই ছিল যুদ্ধবন্দী বা ক্রীতদাস। যুদ্ধবন্দীদেরও বলি দেওয়া হত, যাতে ভয়টা ছড়িয়ে পড়ে। ধারণা করা হয়, অনেকে স্বেচ্ছায়ও বলি হতেন। স্বেচ্ছাসেবীরা বিশ্বাস করতেন, এটি একটি পবিত্র ও গর্বের কাজ। তাঁরা এও মনে করতেন, আত্মাহুতির মাধ্যমে পরজন্মে সূর্যদেবতার সৈন্যশিবিরে স্থান পাওয়া যায়।