দ্বারকেশ্বর নদের গায়ে রাংতাখালির কুণ্ডু বাড়ির পুজোর বয়স প্রায় ৩৫০ বছর। কুণ্ডু পরিবারের থেকো জানা গিয়েছে, পুজোর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জমিদার গোবিন্দ কুণ্ডু।  এ বাড়ির দুর্গা পুজোয় থাকে না কোনও প্রতিমা । পাকা  দু’তলা ঠাকুর দালানে অষ্টধাতুর জয়া-শীতলা-মনসা মূর্তিকেই দুর্গা রূপে পুজো করা হয়। প্রথমার দিন ঢাক আসে। চতুর্থীর দিন পাশেই দ্বারকেশ্বর নদের পলি দিয়ে অষ্টধাতুর মূর্তির গা মাজেন ব্রাহ্মণরা। ওই দিনই অষ্ট ধাতুর মূর্তিতে দুর্গার পোষাক এবং অলংকার দিয়ে সাজানো হয়। এখন সেই জমিদার পরিবার ভেঙে প্রায় দুশোর বেশি পরিবার হয়েছে। দু-চারটি পরিবার গ্রামে থাকেন। বাকিরা থাকেন অন্যত্র কিন্তু পুজোর চারটে দিন তারা অনেকেই রাংতাখালি আসেন।

পুজোর ঠিক ৩০ দিন আগে বাঁধানো মণ্ডপের দোতলা ছাদের উপর প্রায় ৪০ ফুট উঁচু বাঁশের ডগায় লাল পতাকা ওড়ানো হয়। এই ‘নিশানা’ হল প্রতিবেশী ৮-১০টি গ্রামের নিমন্ত্রণ পত্র। নবমীর দিন যাঁরাই আসবেন তাঁদের মাংস-ভাত খাওয়ানোর রীতি। এই রীতি এখন আছে বটে কিন্তু ২০টি পাঁঠার বদলে দুটি পাঁঠা বলি হয়। সেই পাঁঠাও এক মাস আগে কিনে লালন-পালন করতে হয়। রাংতাখালির জমিদার বাড়ির বর্তমান প্রজন্মর থেকে জানা যায়, তাদের প্রাচীন পুজোর অনেক ঐতিহ্যের মধ্যে অন্তত অষ্টমীর দিনের রীতিনীতি টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। ওই দিনই শুধু পরিবারের মহিলাদের অনুষ্ঠান। সন্ধিক্ষণ বা ‘খ্যান’-এর পুষ্পাঞ্জলির সময় ১০৮টি প্রদীপ জ্বালানো হয়।সধবা এবং বিধবা মহিলারা পুষ্পাঞ্জলি দেন নিজের বিয়ের বেনারসী শাড়ী পরে। বিধবারাও পোকায় কাটা বেনারসী পরেন, অনেকটা কনের অবস্থায় দেখতে গ্রামের মানুষ ভিড় করেন। পুষ্পাঞ্জলির পর ধুনো পোড়ানো অনুষ্ঠান হয়। সেখানে পরিবারের বধূদের মাথায় এবং দুহাতে ধরা মাটির পাত্রে ধুনো জ্বলানোর সময় তাঁদের কোলে শিশুদের বসানো হয়। এই প্রথা সমস্ত শিশুদের মঙ্গল কামনায়।

A8316-15 Places to Visit in Kolkata for Travelling Architect

অতীতে পুজোর মূল আকর্ষণ ছিল যাত্রা প্রতিযোগিতা। এখন বন্ধ। ঝাড় লণ্ঠনগুলি বিক্রি হয়ে গিয়েছে। কাঙ্গালী এবং সাহায্যপ্রার্থীরাও কেউ আসেন না। ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে দু-একজন ভিক্ষাজীবীকে কিছু অর্থসাহায্য করেন পরিবারের সবচেয়ে বয়স্ক সদস্য। গ্রামীণ যাত্রাশিল্পীদের হাতেখড়ি এবং যাত্রাপালার প্রতিযোগিতাই ছিল মূল আকর্ষণ। পুজোর চারদিন ধরে পৌরাণিক, ভক্তিমূলক, ঐতিহাসিক এবং সামাজিক পালায় মুখর হয়ে উঠত আরামবাগের রাংতাখালি গ্রামের জমিদার কুণ্ডু বাড়ির পুজো। দূর-দূরান্ত থেকে যাত্রা শুনতে আসতেন মানুষজন। গ্রাম বাংলার প্রাচীন সংস্কৃতির অন্যতম এই ধারাটি ধীরে ধীরে উধাও হয়ে যাচ্ছে। উধাও হয়ে যাচ্ছে আরও অনেক ঐতিহ্য। তবু এখনও যেটুকু সেই ঐতিহ্য টিকে আছে, তা-ই রাংতাখালির পুজোকে আরামবাগ মহকুমার অন্য পুজোর থেকে আলাদা করে রেখেছে।

????????????????????????????????????

অন্যদিকে সাড়ে তিনশো বছর ধরে আর এক পুজো শুরু হয় মুসলিম সম্প্রদায়ের নমাজের সুরের সঙ্গে। মুসলিমরা নমাজ পড়া শেষ করলে হয় আরতি তারপর শুরু হয় পুজো। মা দুর্গার আবাহনে এই রীতিই চলে আসছে প্রাচীন কাল থেকে। ৩৫০ বছর আগে এই পুজো শুরু করেছিলেন জমিদার বাবুরাম সরকার। তাঁর জমিদারিতে বাস করতেন অনেক মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। বাবুরাম প্রজা বৎসল বলেই পরিচিত ছিলেন৷ তিনি নিজে খোলা মনের মানুষ ছিলেন বলেও জানা যায়৷ তাই মুসলিমওদেরও নিজের সংস্কৃতির মধ্যে জায়গা করে দিয়েছিলেন। দুই সম্প্রদায় মিলে মিশে দুর্গাপুজোর আয়োজন করতেন। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, যখন জাতপাতের বিচার সবচেয়ে বেশি ছিল, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে কীভাবে এই বিষয়টা সম্ভব হল৷

???????

আসলে ভারতের ঐক্য, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য প্রাচীন ও প্রবাহমান। বিশেষত বাংলার আনাচে কানাচে এমন অসংখ্য উদাহরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে৷ তেমন অনেক উদাহরণই আবার জড়িয়ে আছে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে। তেমনই এক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদাহরণ আরামবাগের ভালিয়া এলাকার সরকার বাড়ির বনেদি আনায় পূর্ণ দুর্গাপুজো৷ পরিবার থেকেই জানা যায়, পুজোটা প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের পুরনো৷ বাবুরাম সরকার এই পুজো শুরু করেন৷ পুজোর তিনদিন বেদিতে মুসলিমরা আরাধনা করেন৷ আর এদিকে আরতি করা হয় মন্দিরে৷ এটা সেই প্রথম থেকেই হয়ে আসছে৷ গ্রামের মুসলিম সম্প্রদায় এই পুজোয় অংশগ্রহণ করে আসছে৷ আগে গ্রামীণ যাত্রাপালা হত৷ এখন যাত্রা উঠে গিয়েছে৷ অনুষ্ঠানও কম গিয়েছে৷ তবে পুজোটা আজও নিয়ম করেই হয়৷ আরামবাগের ভালিয়ার সরকার বাড়ির সদস্যদের পুজোর চারটে দিন কাটে আনন্দে হই হুল্লোড় করে৷ সমস্ত ধর্মীয় জাতপাতের ভেদাভেদ ভুলে হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মানুষের এই মেলবন্ধন আজও সাম্প্রদায়িকতার একটি নিদর্শন বহন করে চলেছে৷

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version