গোয়েন্দাগিরিতে পুরুষেরা প্রাধান্য পেলেও মিহিলারাও কিন্তু আছেন। বাস্তবে কিন্তু তাঁরা অলীক কল্পনা নন। এমনকি এদেশেও দাপটের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন তাঁরা। প্রথম যে ভারতীয় মেয়ে এই পেশায় যোগ দেওয়ার সাহস দেখিয়েছিলেন তিনি রজনী পণ্ডিত। জন্ম মহারাষ্ট্রের থানে জেলায় একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে। বাবা ছিলেন সি. আই. ডি. আধিকারিক, মহাত্মা গান্ধি হত্যা তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারদের মধ্যে একজন ছিলেন তিনি। মুম্বইয়ের রূপারেল কলেজে মারাঠি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করে মাস তিনেক একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন রজনী, কিন্তু এই কাজ মোটেও তাঁর মন ছিল না। ছোটোবেলা থেকেই তিনি রহস্য সমাধানে আগ্রহী ছিলেন এবং গোয়েন্দাগিরিকেই পেশা করতে চেয়েছিলেন। জীবনের প্রথম কেসটির সমাধান রজনী করেছিলেন কলেজে পড়াকালীন। কলেজের এক সহপাঠীর আচার-আচরণ অস্বাভাবিক লাগায় তিনি কলেজে এবং কলেজের বাইরে মেয়েটির সম্পর্কে খোঁজখবর নেন। মেয়েটিকে অনুসরণ করে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে বুঝতে পারেন মেয়েটি বদসঙ্গে পড়েছে এবং দুষ্টচক্রে জড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন চাপে পড়ে ওই চক্র থেকে মেয়েটি বেরিয়ে আসতে পারছিল না। রজনী মেয়েটির পরিবারকে এই সমস্ত ঘটনা জানান, কিন্তু মেয়েটির পরিবার তাঁকে বিশ্বাস করে না। এরপর রজনী মেয়েটির বিভিন্ন কার্যকলাপের ছবি তুলে প্রমাণসহ তার বাবাকে সব বলেন। উপযুক্ত প্রমাণ পেয়ে মেয়েটির পরিবার রজনীর কথাকে গুরুত্ব দেয় এবং ধীরে ধীরে মেয়েটিকে খারাপ পথ থেকে বার করে নিয়ে আসে।
কলেজজীবনের এই ঘটনার পরেই রজনী পেশাগতভাবে গোয়েন্দা হওয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছিলেন। পড়াশোনা শেষে কিছুদিন চাকরি করে সেই চাকরি ছেড়ে তিনি নিজেই গোয়েন্দা সংস্থা খোলেন। মেয়ের এই কাজে প্রথমদিকে তাঁর বাবা একেবারেই সমর্থন করেননি। কিন্তু রজনীর মা জানতেন মেয়ের একরোখা আর জেদি স্বভাবের কথা, তাই মেয়ের সিদ্ধান্তের কথা জানার পর তিনি মেয়েকে সমর্থন করেছিলেন। গতে বাঁধা জীবন ছেড়ে দিয়ে অনিশ্চিত জীবনের দিকে পা বাড়ানোর সময়েও রজনীর মাই তাঁকে সবচেয়ে বেশি মানসিক শক্তি জুগিয়েছিলেন। বহু বাধা-বিপত্তি এবং লোকজনের তির্যক মন্তব্য উপেক্ষা করে আত্মবিশ্বাসী রজনী তাঁর গোয়েন্দা সংস্থা ‘রজনী পণ্ডিত ডিটেকটিভ সার্ভিস’ শুরু করেন। সরাসরি গোয়েন্দার পেশায় আসার পর রজনী বুঝতে পারেন, আশেপাশে এমন অনেক মানুষ আছেন যাঁরা বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছেন, কিন্তু নিজেরা তার সমাধান করতে পারছেন না। অথচ কোনও তৃতীয় ব্যক্তির হস্তক্ষেপে সেই সমস্যার সমাধান করা খুব একটা কষ্টসাধ্য নয়। এই তৃতীয় ব্যক্তি হয়েই একজন গোয়েন্দা সেই সমস্যার সমাধান করতে পারেন। প্রায় ৭,৫০০ কেসের সমাধান করেছেন রজনী। এর মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক বা পরকীয়া, বিয়ের আগে পাত্রপাত্রী সম্পর্কে বিশদ তথ্য সংগ্রহ, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অবিশ্বাস ও সেই সংক্রান্ত সমস্যা, চুরি, এই ধরনের ঘটনাই বেশি৷ আর এইসব কেসের মীমাংসা করতে গিয়ে গৃহ পরিচারিকা, অন্ধ মহিলা, ফেরিওয়ালা, গর্ভবতী মহিলা, এমন অনেক ছদ্মবেশ ধারণও করতে হয়েছে তাঁকে। এইসব ছদ্মবেশের আড়ালে থেকে আমাদের বইতে পড়া বা সিনেমায় দেখা গোয়েন্দাদের মতোই রহস্য সমাধানের সূত্র খুঁজে বার করেন রজনী।
এখনও পর্যন্ত রজনীর জীবনে সবচেয়ে স্মরণীয় কেস একটি খুনের আসামিকে খুঁজে বার করা। তিনি জেনেছিলেন এক মহিলা তার স্বামীকে লোক লাগিয়ে খুন করিয়েছে। পুলিশও এই খুনের তদন্ত করছিল, কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে আসামিকে ধরতে পারছিল না। সেই মহিলার জনৈক প্রেমিক খুনটি করেছিল, সে শুধু রাতেই মহিলার বাড়িতে আসত। তাকে ধরার জন্য রজনী প্রায় ছ’মাস ওই মহিলার বাড়িতে গৃহ-পরিচারিকার ছদ্মবেশে থেকে প্রমাণ জোগাড় করতে শুরু করেন। একদিন লোকটির সঙ্গে তর্কাতর্কির পরে মহিলা লোকটিকে তার বাড়িতে আর আসতে বারণ করে, কারণ তার মনে হয়েছিল স্বামীর খুনের ব্যাপারে তাদের সন্দেহ করা হচ্ছে। এটাই মোক্ষম সুযোগ বুঝে রজনী ডাক্তারখানায় যাওয়ার ছুতো করে বাড়ি থেকে বেরোন এবং পুলিশে খবর দেন। পুলিশ এসে মহিলার বাড়ি থেকে অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে। গোয়েন্দার পেশায় দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে রজনী বইও লিখেছেন, ‘Faces behind Faces’ এবং ‘maya jaal’। তাঁকে নিয়ে ‘লেডি জেমস বন্ড’ নামে একটি তথ্যচিত্রও তৈরি হয়েছে। তাঁর দীর্ঘ পরিশ্রমের পুরস্কার হিসেবে রজনী দূরদর্শন থেকে ‘হিরকানি অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন, পরবর্তীতে পেয়েছেন ‘ইনভেস্টিগেশন প্রফেশনাল অফ দ্য ইয়ার’ সম্মান। নারী হিসেবে তিনি যেমন পুরুষের একচ্ছত্র অধিকারের ক্ষেত্রে নিজের জায়গা প্রতিষ্ঠা করেছেন, তেমনই কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গবিভাজনের অসারতা নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছেন ভারতের প্রথম এই মহিলা গোয়েন্দা।
রজনীর এক সহকর্মী একবার তাঁকে জানান কিছুদিন ধরে তাঁর গয়না চুরি হচ্ছে। সেই মহিলার তিন ছেলের মধ্যে একজনের সদ্য বিয়ে হয়েছিল। স্বভাবত মহিলা ভেবেছিলেন নতুন বউটিই চুরি করছে, কিন্তু প্রমাণ না থাকায় কাউকে কিছু বলতে পারেননি। রজনী তখন কিছুদিন মহিলার বাড়ির উপর লক্ষ রাখেন ও দেখেন সবাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর মহিলার ছোটো ছেলে মায়ের গয়না চুরি করে। সহকর্মীর এই কেসটির সমাধান রজনী করেছিলেন বিনা পারিশ্রমিকে।