তিনি জার্মানি ভ্রমণ করেছিলেন তিনবার। প্রথম ১৯২১ সালে, এরপর ১৯২৬ এবং সর্বশেষ ১৯৩০ সালে। ইতিমধ্যে তার দু’ডজন জার্মান ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তিনি জার্মানের যেখানেই বক্তৃতা দিতেন সেখানে তিল ধারণের ঠাঁই হত না। অনেক বয়সে তিনি ছবি আঁকতে শুরু করেছিলেন, রঙিন কালি আর গোয়াশে আঁকা অনেকগুলি ছবির জায়গা হয় লন্ডনের একটি প্রথম সারির জাদুঘরে। এরপর রবীন্দ্রনাথ নিজেই ছবিগুলি জার্মানিকে উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু এরপর নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবিগুলি খারিজ করে দেয় জার্মানির নাৎসি শাসক। ছবিগুলিকে ‘অনুপযুক্ত’ এবং ‘অপজাত’ চিত্রকর্ম আখ্যা দেয় নাৎসিরা এবং তার প্রধান হিটলার।

ফ্যাসিস্ট হিটলার নিজেই ছিলেন একজন ব্যর্থ চিত্রশিল্পী। পোস্ট-ইমপ্রেশনিস্ট আধুনিক চিত্রকর্মকে তিনি ‘উন্মাদগ্রস্ত মনের প্রমাণ’ হিসেবে দেখতেন। নাৎসিপ্রধান জার্মানির জাদুঘরগুলি থেকে প্রায় ১৬ হাজার ছবি সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। যেগুলির মধ্যে ভ্যান গগ ও ম্যান রে’র একটি করে ছবিও ছিল। হিটলারের চিত্রকর্মবিরোধী কেন রবীন্দ্রনাথের ছবিগুলিকে তাঁর আক্রমনের লক্ষ্য করেছিলেন সে বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায়না। তবে চিত্রকলা ঐতিহাসিকেরা মনে করেন, রবীন্দ্রনাথের ছবিগুলি বিশিষ্টতার দিক থেকে আধুনিক হওয়ার কারণেই এগুলির উপর নাৎসিদের প্রবল আক্রোশ ছিল। হিটলার একবার বলেছিলেন, ‘যারা আকাশকে সবুজ আর জমিকে নীল হিসেবে দেখে ও আঁকে, তাদের সবাইকে খোজা করে দেওয়া উচিত।

ইউরোপে ১৯৩০ সালে রবীন্দ্রনাথের প্রায় ৩০০টি ছবির একটি একক প্রদর্শনীর হয়। যেগুলির মধ্যে ১০০টির বেশি প্যারিসে ও প্রায় অর্ধেক ছবি বার্লিনের ন্যাশনাল গ্যালারি অব আর্ট-এ প্রদর্শতি হয়। এরপর লন্ডনেও প্রদর্শনীর জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের ছবিগুলি বার্লিনের বারোক প্রিন্স প্যালেসে রাখা হয়েছিল। হিটলারের শুদ্ধিকরণ অভিযান চালু হওয়ার পর এক নির্বাসন তালিকায় তার পাঁচটি ছবির নাম দেখা যায় বলে জানান আর্ট হিস্টোরিয়ান কনস্ট্যান্টিন ভেঞ্জলাফ। নাৎসিদের নিন্দিত একটি ছবি বর্তমানে মিউনিখের একটি জাদুঘরে রয়েছে। কনস্ট্যান্টিন ভেঞ্জলাফের লেখা অনুযায়ী, গ্যালারি থেকে রবীন্দ্রনাথের ছবিগুলো ‘অদৃশ্য হয়ে যায়’ এবং ‘এখন পর্যন্ত এগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি’। তবে তিনটি ছবি ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে ভারতে যোগাযোগ করেছিল রাইখ মিনিস্ট্রি অব পাবলিক এনলাইটেনমেন্ট অ্যান্ড প্রোপাগান্ডা। আরেক আর্ট হিস্টোরিয়াস আর. শিব কুমার রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর্ম নিয়ে বিস্তৃত গবেষণা করেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, ওই তিনটি ছবি রবীন্দ্রনাথকে ফেরত পাঠানো হয়েছিল, বাকি দুটি হারিয়ে গিয়েছে।

তবে মিউনিখের পিনাকোঠেক দ্য মর্ডান মিউজিয়ামের মডার্ন আর্টের প্রধান কিউরেটর অলিভার কেসা জানান, হারিয়ে যাওয়া দুটি ছবির মধ্যে একটি মিউনিখের দ্য বাভারিয়ান স্টেট পেইন্টিং কালেকশনস-এর সংগ্রহে আছে। ড. অলিভার ওই ছবিটিকে একটি ‘অর্ধ-ছায়াবৃত মাথা’ হিসেবে উল্লেখ করে এটিকে ‘কৃচ্ছ্র ও স্বপ্নালুভাবে পরলৌকিক’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। দ্বিতীয় ছবিটি ১৯৯৬ সালের অক্টোবর মাসে এক নিলামের মাধ্যমে ব্রিটেনের একজন ব্যক্তিগত সংগ্রাহক কিনে নিয়েছিলেন। ‘ভারতে রবীন্দ্রনাথের কাছে ফেরত পাঠানো বাকি তিনটি ছবি হারিয়ে গিয়েছে। তথাকথিত ‘অধঃপতিত’ ছবিগুলোকে ব্যঙ্গ করতে নাৎসিরা একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল, সেখানে দেখা যাচ্ছে অ্যাডলফ হিটলার তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী হারম্যান গোয়েরিংকে। অধ্যাপক শিব কুমারের বিশ্বাস তিনি ‘খুব সম্ভবত ফেরত দেওয়া একটা ছবি বিশ্বভারতীর আর্কাইভে দেখেছিলেন’।

ষাট বছর বয়সের মাঝামাঝিতে এসে রবীন্দ্রনাথ আঁকাআঁকি শুরু করেছিলেন। চিত্রশিল্পী হিসেবে তিনি ১৯৪১ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত প্রায় ২,৩০০টি ছবি এঁকেছেন। নিজের পাণ্ডুলিপিতে আঁকজোক কাটতেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের আঁকা চিত্রকর্মের মধ্যে আছে কাল্পনিক প্রাণী, জ্যামিতিক নকশা, নারী, নিজের ছবি, ল্যান্ডস্কেপ, মানুষের মতো দেখতে মুখোশ ইত্যাদি। আর্ট হিস্টোরিয়ানরা মনে করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রশিল্প আর্ট ন্যুভের দ্বারা প্রভাবিত ছিল। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন ভারতে তার চিত্রকর্মে স্বাধীনতার একটি ধারণা তৈরি করতে। রবীন্দ্রনাথের পাঁচটি চিত্রকর্ম ছিল বার্লিন জাদুঘরে। রঙিন কালি আর জলরঙে আঁকা ছবিগুলি তিনি ১৯৩০ সালে জার্মানিকে উপহার দিয়েছিলেন। তার সাত বছর পরেই ১৯৩৭ সালে নাৎসি বাহিনী চিত্রকর্মগুলিকে ‘ডিজেনারেট’ শিল্পকর্ম হিসেবে আখ্যা দেয়।

১৯৪১-৪২ সালে নাৎসি যুগে হারিয়ে যাওয়া চিত্রকর্ম নিয়ে তোড়জোর শুরু হলে সামনে আসে রবীন্দ্রনাথের নাম। তার দুইটি চিত্রকর্মকে অন্য চিত্রকর্মের দ্বারা বিনিময় করা আর দুইটিকে নষ্ট হিসাবে উল্লেখ করা হয়। তিনটি চিত্রকর্ম পরবর্তীতে ভারতে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বাকি দুটি হারিয়ে গিয়েছে। নিজের চিত্রকর্মকে রবীন্দ্রনাথ ’শেষ বয়সের প্রিয়া’ বলে অভিহিত করতেন। জীবন থেকে ষাট বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরে তিনি শুরু করেন ছবি আঁকা। ১৯৪১ সালে মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি যত ছবি একেছিলেন চিত্রকর্মগুলিকে আধুনিক শিল্প নিয়ে তার জ্ঞানের পরিধি ঠাহর করা যায়।
