রবীন্দ্র সংগীত পূর্ব পাকিস্তানে যথাকযথ সম্মান তো পেতোই না বরং বাধাগ্রস্ত হত৷ সেই বাধা মনে প্রানে যারা ভাঙতে চেয়েছিলেন এবং ভেঙেওছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সনজীদা খাতুন৷ কেবল তাই নয় বিপুল বাধার মুখে রবীন্দ্র-শতবর্ষ উদযাপন, ছায়ানট প্রতিষ্ঠা, বটমূলের বর্ষবরণ ইত্যাদি যে বাংলাদেশের বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনকে ঋদ্ধ করেছে সেই ভিত্তিভূমি গড়ে তুলবার সাধনায় ব্রতী ছিলেন সনজিদা খাতুন। একথা বললে অত্যুক্তি করা হয়না যে তিনি বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশে আত্মনিবেদিত এবং বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জগতের এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। ভাষা-আন্দোলন, বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধপরবর্তী দেশগঠনে তিনি ছিলেন অগ্রণী সাংস্কৃতিক নেত্রীর ভূমিকায়। তাঁরই নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ছায়ানটের মত প্রতিষ্ঠান। শুদ্ধ সংগীত চর্চার মশ্যেই তিনি বাঙালি আত্মপরিচয় খুঁজে বেড়াতেন। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার সময়। সহযোদ্ধাদের কাছে পরিচিত হয়েছিলেন মিনু আপা নামে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এই সাংস্কৃতিক ব্যক্তি বাংলাদেশের ইতিহাসের কালরাত্রির দিনেই পাড়ি জমালেন।
সংহতির ধোঁয়া তুলে আইয়ুব খান রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধ করার চেষ্টা শুরু করেছিলেন- রবীন্দ্র শতবর্ষ উপলক্ষে যাতে বাংলাদেশের কোথাও কোনো অনুষ্ঠানের উদ্যোগ না করা হয় তার জন্য রাষ্ট্রীয় মদদে তৎপর হয়ে ওঠে সবাই। পরবর্তীতেও ভারত-পাক যুদ্ধের সময় পাকিস্তান রেডিও থেকে রবীন্দ্রসংগীতের প্রচার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। যদিও পাকিস্তানি শাসনামলে চূড়ান্ত রবীন্দ্রবিরোধিতাতেও বিভিন্ন বিশিষ্টজনেদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালিত হয়। আর সেই উদযাপনের মধ্যে দিয়েই তৈরি হয় ছায়ানট প্রতিষ্ঠার ভিত্তিভূমি। ছায়ানটের প্রথম কমিটি গঠন করা হয় সুফিয়া কামালকে সভাপতি এবং ফরিদা হাসানকে সম্পাদক করে। সনজীদা খাতুন সরকারি কলেজের চাকরির সুবাদে কোনো পদে আসীন হতে পারেননি, সরাসরি জড়িতও থাকতে পারেননি। কারণ জড়িত থাকার অভিযোগ এলে তার চাকরিতে অসুবিধা ঘটবে। ওই বছরই ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে ছায়ানটের প্রথম অনুষ্ঠান হয়। এই অনুষ্ঠানে সমগ্র বাংলার বিশিষ্ট সুরকার ও গীতিকারদের গান পরিবেশিত হয়েছিল আর সংগীত পরিবেশন করেছিলেন তৎকালীন বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী ফেরদৌসী রহমান। ১৯৬৩ সালে সনজীদা খাতুনের উদ্যোগে বাংলা একাডেমির বারান্দায় সংগীত শেখার ক্লাস শুরু হয়। এরপর রবীন্দ্রবিরোধী পাকিস্তান সরকারের তৎপরতা জোরদার হয়ে ওঠে। ‘ছায়ানটে জড়িত থাকার অপরাধ’-এ সুফিয়া কামালকে কয়েক দফা রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়তে হয়।
ষাটের দশকের পাকিস্তানি শাসকের নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সালে বর্ষবরণের সূচনা হয়। রাখঢাক না করে প্রকাশ্যে মন্ত্রীরা রবীন্দ্রবিরোধী বক্তব্য দেওয়া শুরু করলে তারই প্রতিবাদে খোলাখুলি রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার কথা ভাবতে হয় শিল্পীদের। ছায়ানটের শিল্পীদের মতামতের ভিত্তিতে ওই বছর খোলামঞ্চে গান গাওয়ার বিষয়টি আসে। রমনা বটমূলে জঙ্গল কেটে প্রথমবারের মতো খোলা মঞ্চে সমবেত কণ্ঠে ছায়ানটের শিল্পীরা গেয়ে ওঠেন, ‘আলোকের এই ঝরনাধারায় ধুইয়ে দাও’। সেই থেকে ছায়ানট তার সুরের ধারায় প্রতি বছর মাতিয়ে রাখে রমনার বটমূল। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের কোনো বাধা-ই ছায়ানটের আয়োজন দমাতে পারেনি। শুরু থেকেই ছায়ানটের সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে ছিলেন সনজীদা খাতুন। এরপর ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ সবেতেই সংস্কৃতি কর্মী হিসেবে নিজের স্বাক্ষর রেখে গিয়েছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ও ওয়াহিদুল হকের সক্রিয় উদ্যোগে গড়ে ওঠে ‘রূপান্তরের গান’র দল। সেই গানের দল মুক্তিযোদ্ধা, শরণার্থীশিবিরসহ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় সাধারণ মানুষকে যুক্ত করার জন্য রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন। ওই সময় রবীন্দ্রনাথের গান হয়ে উঠেছিল মানুষকে একত্রিত করে তোলার মাধ্যম আর গানের দলের আন্দোলনের হাতিয়ার। বাংলা ভাষা রক্ষায় এবং একটি মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সনজীদা খাতুনের এই প্রচেষ্টা বাংলাদেশ আজীবন স্মরণ করবে।
সন্জীদা খাতুনের লেখার একটি বড় অংশ জুড়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ। ব্যাপক পরিসরে জনমানসে রবীন্দ্রনাথকে পৌঁছে দেওয়ার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে তাঁর। একাধারে শিল্পী, লেখক, গবেষক, সংগঠক, সংগীতজ্ঞ ও শিক্ষক সন্জীদা খাতুন ১৬টি বই লিখেছেন। ‘সাংস্কৃতিক মুক্তিসংগ্রাম’ বইটি তাঁর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, দু’খণ্ডের ‘আমার রবীন্দ্রনাথ” তাঁর রবীন্দ্রযাপন, বাঙালি জীবন, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে রবীন্দ্রনাথের অবদান, রবীন্দ্রকবিতা, রবীন্দ্রসংগীত এবং রবীন্দ্রভাবনার দশ দিগন্ত নিয়ে নানা স্বাদের রচনা৷ একই সঙ্গে শান্তিনিকেতন, শিলাইদহ, পতিসরসহ বিভিন্ন রবীন্দ্রতীর্থ নিয়ে লেখকের স্মৃতি ও অবলোকনও স্থান পেয়েছে ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’- এ। অন্য বইগুলি ‘রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভাবসম্পদ’, ‘রবীন্দ্রনাথের হাতে হাত রেখে’, ‘রবীন্দ্রনাথ: তাঁর আকাশ ভরা কোলে’, ‘রবীন্দ্রনাথ: বিবিধ সন্ধান’, ‘তোমারি ঝরনাতলার নির্জনে’, ‘রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য’, ‘রবীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথ’, ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত: মননে লালনে’, ‘রবীন্দ্র-বিশ্বাসে মানব-অভ্যুদয়’। এছাড়া রয়েছে রবীন্দ্র বিষয়ক সম্পাদিত বই- ‘রইল তাঁহার বাণী: রইল ভরা সুরে’, ‘গীতবিতান: তথ্য ও ভাবসন্ধান’, ‘সার্ধশততম জন্মবর্ষে রবীন্দ্রনাথ’।