কলকাতা ব্যুরো: বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল জয়ের পর একই বছরে কলকাতা পুরসভা দখল করে নিজেদের কর্তৃত্ব জারি রাখল তৃণমূল কংগ্রেস। কলকাতায় ছোট লালবাড়ি যে তাদের দখলে থাকবে এ নিয়ে অতি বড় তৃণমূল বিরোধীরও কোন আশংকা ছিল না। কিন্তু জল্পনা ছিল কতগুলি আসন দখল করবে মমতার দল, তা নিয়েই। দিনের শেষে বিরোধীদের জন্য মাত্র ১০ টি আসন জনতা দিয়ে, বাকি ১৩৪ টিতে তারা ভরসা রেখেছে তৃণমূলের উপরে। ফলে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে আবার কলকাতার দায়িত্ব পেয়ে গেল রাজ্যের শাসক দল। স্বাভাবিকভাবেই এই জয় মানুষের পাশে থাকার ফল বলেই তাবিজ তৃণমূল নেতৃত্বের।
কলকাতার পুরভোটে তৃণমূলের বিপুল জয় যদি মুদ্রার একদিক হয়, তবে অন্যদিকে আলোচনা করতে হয় বাম-বিজেপি ও কংগ্রেসকে নিয়েও। কলকাতার এই নির্বাচনে সবচেয়ে বড় বা নজরকাড়া খবর, একদশক বাদে ফের বাম তথা সিপিএমের প্রাপ্ত ভোট নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। আর সেখানেই বিরম্বনা বাড়িয়েছে বিজেপির। তৃণমূল মোট ভোটের ৭২ শতাংশ নিজেদের বাক্সে তুলেছে। যেখানে বিজেপি পেয়েছে প্রায় ৯%। বাম দলগুলো মিলিয়ে প্রাপ্ত ভোট প্রায় ১২ শতাংশ। আবার সিপিএম একাই প্রায় ১০% ভোট পেয়েছে। কংগ্রেস ৪ শতাংশ ভোট নিজেদের পেকেটে ভরেছে।
ফলে অংকের হিসেবে বা ভোট পাওয়ার নিরিখে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে বামেরা। যা বিজেপির জন্য মোটেই সুখকর খবর নয়। আবার যে ১০ টি আসন বিরোধীদের হাতে গিয়েছে, সেখানে তিনটি আসন পেয়েছে বিজেপি। গতবারের ছিল তাদের সাত টি আসন। ২০১০ সালে বিজেপি এবারের সম সংখ্যক আসন পেয়েছিল। পাশাপাশি এবার দুটি সিপিএম এবং দুটি আসন কংগ্রেস দখল করেছে। সেই তুলনায় তিনটি আসনে নির্দল প্রার্থী জয় পাওয়ায় তৃণমূলের আসন সংখ্যা আরো বাড়বে বলে জল্পনা শুরু হয়েছে।২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যে ১৮ আসনে জয়ে বিজেপিই আগামী দিনে রাজ্যের ভবিষ্যৎ বলে প্রচার শুরু হয়েছিল। কিন্তু বিধানসভা নির্বাচনে তাদের ২০০ আসনের আস্ফালন থমকে গিয়েছিল ৭২ এই। আর তার সাত মাস পরে কলকাতায় তাদের প্রাপ্ত ভোট এক ধাক্কায় অনেকটাই নেমে যাওয়ায়, বিজেপি সম্পর্কে মানুষের মোহভঙ্গ হয়েছে কিনা সেই চর্চাই এখন জোর শুরু হয়েছে।
তৃণমূলের রাজ্যে এক দশক ক্ষমতায় থাকার পরেও কলকাতা পুরভোটে আরো বেশি ভোট পাওয়ায় কাদের কৃতিত্ব বা ব্যর্থতা তাই নিয়ে এখন কাটাছেঁড়া শুরু হয়েছে। একদিকে বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলছেন, তৃণমূলকে শাসন থেকে হটাতে পারে একমাত্র বিজেপিই। সেটা বুঝেই রাজ্যের শাসক দল বিজেপিকে চাপে রাখতে বামেদের ভোট পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। অন্যদিকে সিপিএমের রবীন দেবের বক্তব্য, কৌশলগত কারণেই এবার বাম এবং কংগ্রেস আলাদা আলাদা করে ভোটের লড়াই করেছে। তার ফলেই এই দু’ দলের ভোট আগের তুলনায় বেড়েছে। পাশাপাশি বিজেপি এবং তৃণমূলের মধ্যে গোপন আঁতাত বিজেপির ভোট তৃণমূলের গেছে বলে দাবি বামেদের। তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবশ্য স্পষ্ট বক্তব্য, সারা বছর মানুষের পাশে থাকার জন্যই তৃণমূলের এই জয়। এ প্রসঙ্গে বিজেপি এবং সিপিএমকে কটাক্ষ করেছে তৃণমূল।
যদিও রাজনৈতিক মহলের মতে, গত কিছুদিন ধরে দিদি মোদি তলে তলে জোটের যে অভিযোগ বিরোধীরা করেছিল তা ভোটারদের একটা অংশ বিশ্বাস করে থাকতে পারে। যার ফল এই ভোটে ভুগতে হল বিজেপিকে। তারা মনে করছেন, একদিকে বিধানসভা ভোটের আগে মোদি এবং অমিত শাহ যেভাবে রণহুঙ্কার দিয়েছিলেন ২০০ আসন পাবেন বলে, বাস্তবে ফল তার ধারেকাছেও পৌঁছয়নি। আবার তার পরবর্তীতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিল্লী যাওয়া, প্রধান মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক, বাণিজ্য সম্বালনে প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানানো এবং তিনি আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন বলে আশ্বস্ত করা, একটা বার্তা ছড়িয়েছে। আবার কয়লা এবং গরু পাচার মামলায় মাঝে সিবিআই এবং ইডির যে তৎপর ভাব দেখা গিয়েছিল, তা হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়া চোখে পড়ার মতো ঘটনা বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।
একইসঙ্গে হঠাৎ করেই তৃণমূলের ত্রিপুরা এবং গোয়ায় ক্ষমতার জন্য ঝাপানো ও ত্রিপুরার পুরভোটে লড়াই করা। কংগ্রেসের ঘর ভাঙ্গা, দিল্লি গিয়েও সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে দেখা না করা, নাম না করে কংগ্রেসকে কোণঠাসা করা -যথেষ্টই ইঙ্গিতপূর্ণ বলে ধারণা রাজনৈতিক মহলের। তাদের মতে, যখন দিল্লির বিজেপির সঙ্গে তৃণমূলের এমন একটা বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ দেখা যাচ্ছে, তখন ভোটের পর থেকে রাজ্য বিজেপির লাগাতার তৃণমূলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ বা রাজ্যের শাসকদলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ বারংবার তুললেও শীর্ষ নেতৃত্ব তা ইস্যু না করা, আবার এই সব নিয়ে কেন্দ্রের তরফে কঠোর পদক্ষেপ করার তেমন কোনো ঘটনা দেখা যায়নি। ফলে ২০২৪ এর লোকসভা ভোটের দিকে তাকিয়ে কংগ্রেসের ক্ষমতা কমাতেই মমতাকে দিল্লি বিজেপির এমন বাড়তি অক্সিজেন জোগানোয় রাজ্য বিজেপির এই হাড়ির হাল কিনা, তাই এখন চর্চার বিষয় রাজনৈতিক মহলের।