কলকাতা ব্যুরো: ঠিক পাঁচ বছর আগের আগস্টেই প্রয়াত হয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী শুভ্রা মুখোপাধ্যায়। তখনও তিনি রাষ্ট্রপতি। পাঁচ বছর বাদে আরো এক আগস্টেই নিভল তাঁরও জীবনদীপ। প্রয়াত হলেন দেশের ত্রয়োদশ রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। সোমবার নয়া দিল্লির রিসার্চ এন্ড রেফারেল আর্মি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তাঁর এক কন্যা শর্মিষ্ঠা এবং দুই পুত্র অভিজিৎ এবং ইন্দ্রজিৎ।
সম্প্রতি নয়া দিল্লির বাসভবনে পড়ে গিয়ে মাথায় চোট লাগে তাঁর। সেই সংক্রান্ত চিকিৎসা করাতেই আর্মি হাসপাতালে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে রুটিন পরীক্ষায় ধরা পড়ে তিনি করোনা আক্রান্ত। সে কথা টুইটে জানিয়েছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায় নিজেই। সেদিনই অস্ত্রোপচার হয় তাঁর। মাথার পেছনে জমাট বাঁধা রক্ত বের করতেও সক্ষম হন চিকিৎসকরা। কিন্তু ভেন্টিলেশনেও তাঁর শারীরিক পরিস্থিতি মাঝখানে খানিকটা স্থিতিশীল হলেও, ক্রমে অবনতি ঘটতে থাকে। আজ বিকেলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
রাইসিনা হিলসে রাষ্ট্রপতি ভবনে পৌঁছাতে না পারলে প্রণব মুখোপাধ্যায় হয়তো ভারতীয় রাজনীতির আরো এক ট্র্যাজিক হিরো হিসেবেই থেকে যেতেন। কারণ, ভারতীয় রাজনীতিতে এমন চরিত্র খুব কমই আছেন যিনি অর্থমন্ত্রী থেকে বিদেশ মন্ত্রী কিংবা প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলি সামলেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। ছিলেন যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান, লোকসভা এবং রাজ্যসভার নেতা। অথচ কোনোদিন দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। ইন্দিরা গান্ধি থেকে পি ভি নরসিমা রাও, মনমোহন সিংয়ের আমলে দায়িত্বগুলো সামলেছেন তিনি।
রাষ্ট্রপতি পদ নিয়ে বাঙালিদের মধ্যে তেমন কোনও হেলদোল কোনোকালেই ছিল না। কিন্তু ২০১২ সালে যখন বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা এবং দক্ষ প্রশাসক প্রণব মুখোপাধ্যায়কে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী ঘোষণা করলো দ্বিতীয় ইউপিএ, তখন তা নিশ্চিতভাবেই খানিকটা উৎসাহের জোয়ার এনেছিল বাংলায়। সুযোগ আসা সত্ত্বেও বাম নেতা জ্যোতি বসু প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি তাঁর দলের আপত্তিতে। প্রণবের সামনেও সেই বন্ধ দরজা খোলেনি কোনোদিনও। অবশেষে প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি পাওয়ার সুযোগে দুধের স্বাদ খানিকটা হলেও ঘোলেই মেটাতে চেয়েছিল বাঙালি।
তাঁর রাজনৈতিক উত্থান শুরু হয়েছিল সেই ১৯৬৯ সালে যখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির উদ্যোগে কংগ্রেসের টিকিটে রাজ্যসভায় জয়ী হন বীরভূমের মিরাটি গ্রামের এই ব্রাহ্মণ সন্তান। তখন থেকেই তিনি ইন্দিরার বিশ্বস্ত লেফটেন্যান্ট। ইন্দিরা মন্ত্রীসভাতেও জায়গা করে নেন তিনি। বিতর্কিত জরুরি অবস্থার সময়েও তিনি ছিলেন ইন্দিরার পাশে। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরার মৃত্যুর পর রাজীব গান্ধি প্রধানমন্ত্রী হলে তাঁর সঙ্গে অবশ্য দূরত্ব তৈরি হয় প্রণবের। যার জেরেই ১৯৮৬ সালে তিনি গঠন করেন রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস নামে নতুন একটি দল। তাতে অবশ্য হালে বিশেষ পানি মেলেনি। তিন বছরের মধ্যে তা ফের মিশে যায় কংগ্রেসের সঙ্গে। ১৯৯১ সালে রাজীবের মৃত্যুর পর ফের দ্বিতীয় দফায় শুরু হয় প্রণবের উত্থান।
দীর্ঘ সময় ধরেই রাজ্যসভা থেকে নির্বাচিত হলেও, প্রণবের আক্ষেপ ছিল লোকসভায় জয়ী না-হওয়ার। ২০০৪ সালে মিটেছিল তাঁর সেই আক্ষেপও। ২০০৪ এবং ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তাঁর সেই আক্ষেপ মিটিয়েছিলো জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্র। বিনিময়ে তিনিও সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন ওই কেন্দ্রের উন্নয়নে।
শুধুমাত্র প্রশাসনিক দক্ষতাই নয়, কংগ্রেস আমলে তিনিই ছিলেন দল ও সরকারের অন্যতম ট্রাবল শ্যুটার। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত যোগাযোগ, ক্ষুরধার রাজনৈতিক বিশ্লেষণ-র কারণেই তিনি হয়ে উঠতে পেরেছিলেন ট্র্যাক টু ডিপ্লোমেসির অন্যতম সফল কারিগর। ২০১৭ তে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি পরিদর্শন করেন আরএসএস-র সদর দপ্তর নাগপুরেও। তা নিয়ে সে সময় রাজনীতিতে খানিক বিতর্কও হয়। ২০১৯ সালে দেশের শীর্ষ নাগরিক সম্মান ভারতরত্ন সম্মানও লাভ করেন তিনি।