পাঁচ বছর পর পৌষমেলা। শান্তিনিকেতনের পূর্বপল্লির মাঠে এবার এই মেলা চলবে ছ’দিন। আগে মেলা হত তিন দিন, এবার ছ’দিন হবে। পৌষ মেলাকে ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দেওয়ার পর এবারই প্রথম পূর্বপল্লির মাঠে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই মেলা। প্রতিবছর ৭ পৌষ এই মেলা বসে। এবার ১৩০ বছরে পা রাখলো। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দীক্ষা দিবসকে স্মরণ করে প্রতিবছর বসে এই পৌষ মেলা।১৮৪৩ সালের ২১ ডিসেম্বর বাংলার ৭ পৌষ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের কাছে ব্রহ্মধর্মে দীক্ষিত হন। সেই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে ও ব্রহ্মধর্মের প্রসারের স্বার্থে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৪৫ সালে কলকাতার গোরিটির বাগানে উপাসনা, ব্রহ্ম মন্ত্রপাঠের ব্যবস্থা করেন। যাকে পৌষমেলার সূচনা বলে ধরা হয়। তবে ১৩০১ বঙ্গাব্দের ১ পৌষ যে পৌষ মেলার সূচনা হয়েছিল তা বিশ্বভারতীর কাচ মন্দিরের সামনে এক দিনের জন্য বসত।

প্রসঙ্গত, ১৮৬২ সালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতন আবিষ্কার করে আশ্রম প্রতিষ্ঠার ভাবনা শুরু করেন। অন্যদিকে, ১৮৮৮ সালের ৮ মার্চ মহর্ষি ন্যাস বা ট্রাস্ট ডিডে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পৌষমেলা সম্পর্কে স্পষ্ট উল্লেখ করে যান যে, শান্তিনিকেতন ট্রাস্ট প্রতি বছর একটি মেলা বসাবে। এই মেলা মূলত, সকল ধর্মের মানুষের মিলন ক্ষেত্র হবে, কোনও রকম মূর্তি পুজো হবে না, বিপুল আমোদ উল্লাস হবে না, মদ্য, মাংস ব্যতীত এই মেলায় সব ধরণের খাদ্যদ্রব্য ক্রয়-বিক্রয় হবে। এই ডিডে আরও বলা রয়েছে, যদি এই মেলা থেকে কোনও রকম আয় হয়, সেই টাকা আশ্রমের উন্নতি কল্পে ব্যয় করা হবে। উল্লেখ্য, ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মহাপ্রয়াণে মেলা বসলেও তা প্রাণহীন ছিল। ১৯৪৩ সালে দেশে দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তরের জন্য পৌষমেলা বন্ধ ছিল। ১৯৪৪ সাল থেকে মেলার সময় সমাবর্তন অনুষ্ঠান শুরু হয়। ১৯৫০ সালে মেলার পরিসর বাড়তে থাকায় ব্রহ্ম মন্দিরের পরিবর্তে ছাতিমতলায় উপাসনা শুরু হয়। এরপর ১৯৬১ সালে পৌষমেলার স্থান পরিবর্তন হয়। মন্দির সংলগ্ন মাঠ থেকে মেলা পূর্বপল্লির মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই থেকে এই মাঠেই চলে আসছে মেলা।

২০১৯ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে এই মেলা চলে এলেও ২০২০ সালে করোনাভাইরাসের কারণে মেলা বন্ধ থাকে। তারপরের দু’বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্যের আপত্তিতে পূর্বপল্লির মাঠে এই মেলা অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। ওই দু’বছর বোলপুরের ডাকবাংলোর মাঠে স্থানীয় পৌরসভা ও বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চের উদ্যোগে বিকল্প পৌষ মেলার আয়োজন হয়। গত বছর বিশ্বভারতী ও শান্তিনিকেতন ট্রাস্ট পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারকে মেলার আয়োজন করার দায়িত্ব দিলে তা নিয়েও বিতর্ক তৈরি হয়। তাই শেষ চার বছর জেলা প্রশাসন এই মেলার উদ্যোগ নেয়। এবার আবার বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ পূর্বপল্লির সেই মাঠে আয়োজন করেছে ঐতিহাসিক পৌষ মেলার। বলা বাহুল্য যখন এই মেলার আয়োজন করা হয়েছিল শান্তিনিকেতনের মনোরম পরিবেশে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত উৎসবটি কেবল একটি উদযাপনের চেয়েও বেশি কিছু নয়; এটি বাংলার সাংস্কৃতিক স্থিতিস্থাপকতা এবং শৈল্পিক চেতনার একটি প্রাণবন্ত প্রমাণ। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ থেকে শুরু করে কোভিড-১৯ মহামারীর মতো সময়কালে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও, পৌষ মেলা সময়ের পরীক্ষায় দাঁড়িয়েছে, বিকশিত হয়েছে এবং একটি সাংস্কৃতিক ঘটনাতে ক্রমবর্ধমান হয়েছে যা আশেপাশের দর্শকদের মোহিত করে।

পৌষ মেলা একটি উৎসবের চেয়ে বেশি; এটি পশ্চিমবঙ্গের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি জীবন্ত, শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রকাশ। উৎসবটি স্থানীয় শিল্পী, কারিগর এবং পারফর্মারদের তাদের প্রতিভা প্রদর্শনের জন্য, ঐতিহ্যগত শিল্প ও কারুশিল্প সংরক্ষণ এবং প্রচারের জন্য একটি দুর্দান্ত মঞ্চ হিসাবে কাজ করে। বাউল সঙ্গীতের আত্মা-আলোড়নকারী সুর থেকে শুরু করে স্থানীয় হস্তশিল্পের জটিল নকশা, পৌষ মেলা হল শৈল্পিক অভিব্যক্তি এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি ক্যালিডোস্কোপ। সেই কারণে পৌষ মেলা কাছাকাছি গ্রাম এবং দূর-দূরান্তের মহাদেশের শিল্পী, সঙ্গীতজ্ঞ, কারিগর এবং কবিদের একত্রিত করে। যেখানে আপনি বাউলদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারেন এবং তাদের জীবন এবং প্রেম সম্পর্কে গান শুনতে পারেন বা উপজাতীয় কারুশিল্প এবং পোশাক বিক্রির স্টলে ঘুরে বেড়াতে পারেন। এই মেলার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল বাংলা লোকসঙ্গীতের পরিবেশনা। বিশেষ করে বাউল গান। জানা গিয়েছে, এই বছর প্রায় ১৬০০ স্টল বসছে মাঠে।
