কলকাতা ব্যুরো: রামপুরহাটের বগটুই গ্রাম ‘রাজনীতির আগুনে’ পুড়ে ছারখার। রাতারাতি অগ্নিসংযোগে পুড়ে ছাই ৭-৮টি বাড়ি। প্রাণ গেলো কমপক্ষে ১০ মানুষের। খুব প্রত্যাশিতভাবেই এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই শুরু হয়েছে রাজনীতির নোংরা কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি। কিন্তু বঙ্গ রাজনীতির ইতিহাস বলছে, এর আগেও বহুবার রাজনৈতিক হিংসার নগ্ন রূপ দেখেছে এই বাংলা। বিশেষ করে বাম শাসনের ৩৪ বছরে একের পর এক গণহত্যায় কলঙ্কিত হয়েছে ইতিহাসের পাতা।
সাঁইবাড়ি হত্যাকাণ্ড: বঙ্গ রাজনীতির ইতিহাসের সম্ভবত নৃশংস রাজনৈতিক হিংসার নজির এই সাঁইবাড়ি হত্যাকাণ্ড। রাজ্যে তখনও বামেরা পুরোদমে ক্ষমতায় আসেনি। সেসময় রাজ্যে ক্ষমতায় যুক্তফ্রন্টের সরকার। সিপিএম সেই সরকারের শরিক দল। ততদিনে কংগ্রেস ক্ষয়িষ্ণু। বর্ধমানে কংগ্রেসের দুর্গ আটকে রেখেছিল এই সাঁইবাড়ি। ১৯৭০ সালের ১৭ মার্চ বর্ধমান শহরের প্রতাপেশ্বর শিবতলা লেনে বাড়িতে ঢুকে সাঁইবাড়ির তিন সদস্যকে খুন করা হয়। ছেলের রক্তমাখা ভাত খেতে বাধ্য করা হয় তাঁদের মাকে। খুন হন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত ছাত্র জিতেন রায়ও। অভিযুক্ত সিপিএমের তৎকালীন দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা নিরুপম সেন, বিনয় কোঙাররা।

মরিচঝাঁপি গণহত্যা: পুলিশ দিয়ে পরিকল্পিতভাবে উদ্বাস্তুদের হত্যালীলা। বাংলার ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যাগুলির মধ্যে একটি হল মরিচঝাঁপি হত্যাকাণ্ড। ১৯৭৯ সালের জানুয়ারি মাসে ঘটনাটি ঘটে। তখন সদ্যই রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছে বামেরা। রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু আর কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের জনতা সরকার। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বহু উদ্বাস্তু সেসময় দণ্ডকারণ্য হয়ে সুন্দরবনের মরিচঝাঁপি দ্বীপে আশ্রয় নিয়েছিলেন প্রায় দেড় লক্ষ উদ্বাস্তু। কোনওরকম সরকারি সাহায্য ছাড়াই ওই দ্বীপে নিজেদের বাসস্থান গড়ে তোলেন ওই উদ্বাস্তুরা। কিন্তু সরকার তাঁদের স্বীকৃতি দেয়নি। উলটে ১৯৭৯ সালের ২৪ জানুয়ারি ওই উদ্বাস্তুদের উৎখাত করতে পুলিশ পাঠায় রাজ্য সরকার। মৃতের সঠিক সংখ্যা আজও অজানা।

২১ জুলাই মহাকরণ অভিযান: ১৯৯৩ সালের ২১শে জুলাই ভোটারদের সচিত্র পরিচয়পত্রের দাবিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে মহাকরণ অভিযান করেন যুব কংগ্রেস কর্মীরা। রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আশা বহু যুব কংগ্রেস কর্মী কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে জড়ো হন। মমতার নেতৃত্বে হাজার হাজার যুব কংগ্রেস কর্মী ব্রেবোর্ন রোড ধরে মহাকরণের উদ্দেশে অভিযান শুরু করে। যুব কংগ্রেস কর্মীদের সেই মিছিলে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রসচিব মণীশ গুপ্তের নির্দেশে নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। মোট ১৩ জন যুব কংগ্রেস কর্মী প্রাণ হারান। আহত হন শতাধিক।
নানুর হত্যাকাণ্ড: বীরভূমের মাটি বহুবার রাজনৈতিক হিংসায় রক্তে লাল হয়েছে। বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া নানুর ব্লক। যেখানে মূলত ভূমিহীন, উপজাতি, মুসলিমদের বাস। সেই নানুর শিরোনামে আসে ২০০০ সালের গণহত্যার পর। একটি বিতর্কিত জমিতে চাষ করা নিয়ে ভূমিহীন-রোজগারহীন কৃষকদের উপর নির্বিচারে হামলার অভিযোগ ওঠে সিপিএম সমর্থকদের বিরুদ্ধে। মোট ১১ জনের মৃত্যু হয়। প্রত্যেকেই ছিলেন তৃণমূল সমর্থক।

ছোট আঙারিয়া: প্রায় ২১ বছর আগে গড়বেতার এক অখ্যাত গ্রাম ছোট আঙারিয়ার নাম উঠে এসেছিল সংবাদ শিরোনামে। আবারও এক গণহত্যার জন্য। জঙ্গলমহলে তখন সদ্য সংগঠন গড়ে তুলছে তৃণমূল। ২০০১ সালের ৮ জানুয়ারি গড়বেতার ছোট আঙারিয়া গ্রামে বক্তার মণ্ডল নামের এক তৃণমূল কর্মীর বাড়িতে গোপনে বৈঠকে বসেন তৃণমূল-সহ কয়েকটি বিরোধী দলের কর্মীরা। অভিযোগ খবর পেয়ে সেই বাড়িতে চড়াও হয় সিপিএম আশ্রিত দুষ্কৃতীরা। ১১ জন তৃণমূলকর্মীকে মেরে পুঁতে দেওয়া হয়েছিল। পরে সেইসব তৃণমূলকর্মীদের কঙ্কাল উদ্ধার হয়।
নন্দীগ্রাম গণহত্যা: ২০০৭ সালের জমি অধিগ্রহণের প্রতিবাদে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে নন্দীগ্রাম। তৎকালীন বাম সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে একযোগে প্রতিরোধ গড়ে তোলে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি, তৃণমূল, কংগ্রেস এবং রাজ্যের সুশীল সমাজ। ২০০৭ সালে দুটি গণহত্যা হয়েছিল নন্দীগ্রামে। প্রথমে ১৪ মার্চ ভূমি উচ্ছেদ কমিটির ‘মুক্তাঞ্চল’ দখলের সময় পুলিশি অভিযানে। যাতে পুলিশের পোশাকে সিপিএম আশ্রিত দুষ্কৃতীরা তাণ্ডব চালায়। মারা যান ১৪ জন। বহু মানুষ আহত হন। বহু ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। দ্বিতীয় গণহত্যাটি হয় ১০ নভেম্বর। সেই ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটিরই মিছিলে গুলি চালায় দুষ্কৃতীরা। এবারে প্রাণ যায় ১০ জনের।

নেতাই গণহত্যা: ৭ জানুয়ারি ২০১১ অর্থাৎ রাজ্যে পালাবদলের ঠিক আগে আগে ঝাড়গ্রামের নেতাইয়ের এক সিপিএম নেতা মাওবাদী প্রতিরোধের নামে নিজের বাড়িতেই দুষ্কৃতীদের নিয়ে সশস্ত্র শিবির বসিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল, এলাকায় ভয়ের পরিবেশ তৈরি করা এবং বিরোধীদের উপর চাপ সৃষ্টি করা। কিন্তু সেই ঘটনার প্রতিবাদে সরব হন স্থানীয়রাই। তারপরই ওই সিপিএম নেতার নির্দেশে নির্বিচারে সাধারণ মানুষের উপর গুলি চালিয়ে দেয় দুষ্কৃতীরা। প্রাণ হারিয়েছিলেন ৯ জন নিরীহ গ্রামবাসী।