পুরাণে দেবী দুর্গার বিভিন্ন রূপের বর্ননা পাওয়া যায়৷ কিন্তু পেটকাটি দুর্গার কোনও উল্লেখ পুরাণ কিংবা কোনো গ্রন্থেই পাওয়া যায় না৷ যদিও মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুরের গদাইপুরের প্রাচীন ও বনেদি বাড়ির পুজোর মধ্যে একটি হল এই পেটকাটি দুর্গার পুজো। যে দুর্গার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এক ভিন্ন ইতিহাস। পুরাণ এখানে স্থানীয় ইতিহাসের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার।  কয়েকশো বছরের প্রাচীন এই পুজো আজও একই রীতি মেনেই হয়ে আসছে। প্রাচীন ঐতিহ্য মেনেই আজও একচালার মূর্তি তৈরি হয় ঠাকুর দালানে। তবে এখনও মা পেটকাটির মুখে একটুকরো কাপড় লাগানো থাকে। পায়ে থাকে শিকল।

কিন্তু কেন পেটকাটি দুর্গ, কেনই বা তাঁর পায়ে শিকল। এ নিয়ে রয়েছে এক কাহিনী। কথিত আছে, বহু বছর আগে এক সন্ধ্যায় তৎকালীন সেবায়েতের এক কন্যা লাল শাড়ি পরে সন্ধ্যাপুজো দিতে যায়। কিন্তু তারপর থেকে আর সেই মেয়েটিকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। উদ্বিগ্ন সেবায়েত মেয়ের মঙ্গল কামনায় মাকে ডেকে চলেন। কথিত রয়েছে সেদিন রাতেই সেবায়েতকে স্বপ্নাদেশ দেন দেবী। তিনি জানান যে সেবায়েতের মেয়েকে ভক্ষণ করেছেন তিনিই।সেই সময় বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার আর্থিক সঙ্গতি সম্পন্ন ছিল। তাই দুর্গাপুজোর দেখভালের জন্য এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ নিয়োগ করা হয়। সেই  পুরোহিত তাঁর স্ত্রী ও একমাত্র কিশোরী মেয়েকে নিয়ে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের মন্দিরের পাশে বসবাস করতেন।

এরপর দেবীর পেট কেটে যেন মেয়েকে উদ্ধার করেন ওই সেবায়েত, এমন নির্দেশই ওই সেবায়েত স্বপ্নাদেশে পান। তারপর থেকেই শুরু পেট কাটি দেবীর আরাধনা। ঐতিহ্য মেনে পেট কাটি দেবীর পুজোর সূচনা হয় রথের দিনেই। প্রতিপদ থেকেই পূজিত হন মা। সপ্তমীর সকালে কলা বৌ স্নান থেকে মায়ের ভোগ, সন্ধি পুজো, প্রাচীন প্রথা মেনেই হয় দেবীর আরাধনা। গ্রাম বাংলার পুজোর ঐতিহ্য আর পৌরানিক কাহিনী নিয়ে পেট কাটির পুজো এক অদ্ভুত পরিবেশের সৃষ্টি করে। দূর দূরান্ত থেকে ভক্তদের সমাগমে জমজমাট হয়ে ওঠে মন্দির।

পায়ে শিকল, মুখে কাপড় এভাবেই পুজো হয় পেট কাটি দুর্গার। প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো এই পেট কাটি দুর্গা পুজোর। পেট কাটি দুর্গা প্রতিমা তৈরির সময় থেকেই ওই চিহ্ন স্পষ্ট। কথিত আছে, চার শরিকের এই পুজোয় একটা সময় বলি প্রথা বন্ধ হয়। তবে ইতিহাসের স্রোতে মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জের গদাইপুরের বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারে পেটকাটি দুর্গা আজ সর্বজনীনে পরিণত হয়েছে।  পেটকাটি দুর্গার এমনই মাহাত্ম্য যে বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির ঠাকুরের কাঠামোয় আগে মাটি পড়ে। তারপর জঙ্গিপুরের অন্যান্য বনেদি বাড়ির দেবীর কাঠামোতে মাটির প্রলেপ দেওয়া হয়।

রঘুনাথগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে আহিরণ। ঠিক তার পাশের গ্রাম গদাইপুর। গ্রামের পাশ থেকে বয়ে গিয়েছে আখরি নদী। এই নদীর তীর থেকে মাটি এনেই দেবী মূর্তি গড়া হয়। বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির দুর্গা ন’ফুট দৈর্ঘ্যের ও ১৩ ফুট প্রস্থের। প্রতি বছর একই মাপের মূর্তি গড়া হয়।  পেটকাটি দুর্গা মন্দিরের পিছনে রয়েছে একটি পুকুর। দূরদূরান্ত থেকে পুণ্যার্থীরা পুজোর সময় দেবী দর্শনে আসেন। অনেকে পুকুরে স্নান করেন। পুজো দেন। দশমীর দিন আখরি নদীতে নৌকায় চাপিয়ে দেবীকে নিয়ে আসা হয় রঘুনাথগঞ্জের সদর ঘাটে। ভাগীরথী নদীর তীরে সদর ঘাটের দুই প্রান্তে মেলা বসে। সেখানে শহরের সমস্ত ঠাকুর আনা হয়। একাদশীর দিন বেলা এগারোটা নাগাদ পেটকাটি দুর্গাকে বিসর্জন দেওয়া হয় জঙ্গিপুর শ্মশান ঘাটে। তারপর পায়ে হেঁটে শহর পরিক্রমা করে গদাইপুরে দেবীর মন্দিরে ঘট পাতা হয়। এই পুজো ঘিরে ভক্তদের উৎসাহে এত বছরেও বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি। এই পুজোর নেপথ্যে থাকা ইতিহাস ভক্তদের মনে গভীরভাবে দাগ কাটায় প্রতি বছর বহু দূর থেকেও দেবী দর্শনে ভক্তরা আসেন। পঞ্চমীর দিন থেকেই তাই বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়িতে তিল ধারনের জায়গা থাকে না।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version