দেবর্ষি ভট্টাচার্য
হেমন্তের কপাল জুড়ে এখন পড়ন্ত বিকেলের জলছবি। চরাচর জুড়ে যেন যাই যাই ভাব। চৌদিক বড়ই উদাসী। নিভু নিভু হেমন্তের চোখের পাতায় সহসা এসে জমাট বাঁধে অনাহূত জলভরা মেঘ। অকপট আঁধারের আগ্রাসনে দিনমানেও নিভে আসে আলোর অহংকার। ঝোপে-ঝাড়ে, বনে-বাদাড়ে, কাঁপতে থাকা তিরতিরে চারাগাছের ঠোঁটে, দুলতে থাকা জলফড়িঙের পাখার আকুতি ঘিরে, ঝুপ করে নেমে আসে আলোআঁধারি আবছায়ারা। নিঃসঙ্গ বকুলের ডালে এসে ওম খোঁজে কম্পিত মেঘমালারা। শিটিয়ে যাওয়া পাতার মলিন আঁচলে ডুকরে ওঠে অভিমানী বৃষ্টি।

একজন আলোমাখা সুঠাম লোমশ কিশোর। চোখের তারার শিরা-উপশিরায় হাজার ঝাড়বাতির ঝিকিমিকি। আচমকা একদিন শিকার হতে হল। শিকারী রাজনৈতিক পাশাখেলার। দেশভাগ, জাতিদাঙ্গা, বাস্তুচ্যুতি, আলপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ ‘এলেম নতুন দেশে’। শুরু হল জীবনের ঘামে ভেজা অধ্যায়। সঙ্গী সংগ্রামী জীবন। দারিদ্র্যও। পথ বড়ই বন্ধুর। লড়াই দুরূহ। ছেঁড়া ছেঁড়া স্বপ্নগুলো কিছুতেই যেন জোড়া লাগে না আর। একাকী মুহূর্তে প্লাবনের মতো কষ্টের ফল্গুধারা এসে ক্লিষ্ট করে তনু-মন-প্রাণ। বুকের বাঁদিকের লাল টকটকে অভিমানী মাংসপিণ্ডটা প্লাবিত হয়ে ওঠে বানভাসি রক্তস্রোতে।

নিশুতি রাতে খোলা আকাশের নীচে দাঁড়ায় এসে। পায়ে জড়িয়ে থাকে অবহেলার লতাগুল্ম। পায়ে পায়ে নেমে আসে আকাশও। বুকে ভরে নেয় শপথের শ্বাসে। ফুসফুস থেকে ফিরে আসা কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়াগুলো আলোমাখা আঁচলের খোঁজে কোথায় যেন মিলিয়ে যায়! তবু সে কিন্তু জীবনমুখীই থেকে যায়। হৃদয় জুড়ে রবি ঠাকুর, জীবনানন্দ, মোঁপাসা, গ্যেটে, বিভূতিভূষণের অবাধ বিচরণ। তাই হকের পারিবারিক অংশ হেলাভরে ত্যাগ করেও বুকে টইটুম্বুর বসন্তের দখিণা বাতাস।

জীবনের বাঁকে বাঁকে বারংবার বিদ্ধ হয়েছেন। কষ্ট সয়েছেন পর্বত প্রমাণ। তবু স্বপ্ন দেখেছেন আজন্মকাল ধরে। প্রথম জীবনে নিজেকে নিয়ে। শেষ জীবনে সন্তানদের চোখের পাতা ছুঁয়ে। কষ্ট আর সন্তানদের মাঝে প্রাচীন বটের মতো মহীরুহ হয়ে জীবনভর দাঁড়িয়ে থেকেছেন। উদাসী মনটা মনেপ্রাণে চাইতো, ধোঁয়া ধোঁয়া হেমন্ত সকালে পরিবার নিয়ে নিদেনপক্ষে ডুলুং নদীর পাড় ধরে হাঁটতে। কিন্তু আর্থিক সঙ্গতি বড় বালাই যে। অথচ সেই মানুষটাই নির্বিকার চিত্তে মাইলের পর মাইল হেঁটে গেছেন পরিবারের জন্য একান্ত আপন ছোট্ট একটি আস্তানার সন্ধানে!

সময়ের উজান স্রোতে বয়ে যেতে যেতে শিশিরের মতো হঠাৎ একদিন উপলব্ধি করলেন, এই ভিনদেশে আজ তিনি একজন নিম্ন মধ্যবিত্ত ছিন্নমূল মানুষ মাত্র। আর সব সত্ত্বাগুলো উবে গেছে কোন অগোচরে! তবু শিকড় আজও পড়ে আছে আড়িয়াল খাঁ নদীর পাড়ে। শিকড়ের আলোছায়ায় ফিরে যেতে বারেবারে মন চায়। কিন্তু যাওয়া আর হয়ে ওঠে না। রাতগভীরে ঘুম ভেঙে যায় শিকড়ের মাটির ভুরভুর গন্ধে। ভরদুপুরে পুকুরের জলে জলমাকড়শার কাটাকুটির নীচে ডুবে থাকে বেদনা অস্থিমজ্জা।

চিল চিৎকারে কানে বাজে একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে চুরমার হওয়ার শব্দ, আটচালা ভেঙে পড়ার শব্দ, বাঁশবনের আর্তনাদের শব্দ, নদীপাড় ভাঙার শব্দ, দেশভাগের শব্দ। আজও নিশ্চয় রাতগভীরে গম্ভীর মুখে আগুন জ্বেলে আনমনে হেঁটে চলেন উত্তাল আড়িয়াল খাঁর উন্মনা পাড় বরাবর। একান্তে। নিঃশব্দে। পদচিহ্নে লেগে থাকে চাপ চাপ জমাট রক্তের ছোপ।

আজও, যখন মেঘেদের চোখের পাতায় বিন্দু বিন্দু কষ্টের স্রোত মুক্তের মতো জ্বলে ওঠে, ঝরা পাতার অবহেলিত হৃদয়ে ঝরে পরে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি, তাঁর কথা খুব মনে পরে। ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসে, অথবা বাসের জানালায় উঁকি মেরে, কালো মোটা ফ্রেমের চশমা পরিহিত সেই উদ্বাস্তু প্রৌঢ়কে আমি খুঁজি আজও। পরনে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি, হাতে ঝোলানো কমদামী আপিসের ব্যাগ। মাথাটা সামান্য বাঁদিকে হেলানো। বুকভরা টইটুম্বুর খালবিল, নদীনালা, উত্তাল সমুদ্র …… আর কাঁপা কাঁপা আঙুলময় শেকড়ের ধুলোবালির দাগ।
লেখক অধ্যাপক, সমাজ-রাজনীতি-পরিবেশ বিশ্লেষক