আসামের নলবাড়ি জেলার দু’নম্বর বর্ধনারা গ্রামটি একসময় ফল আর ফসলে বেশ সমৃদ্ধ ছিল। কিন্তু উপযুক্ত সড়ক আর যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে গ্রামটি ধীরে ধীরে জনশূন্য হতে থাকে। দেশের শেষ অর্থাৎ ২০১১ সালের জনশুমারি অনুযায়ী দেখা যায় বর্ধনারা গ্রামটিতে মাত্র ১৬ জন মানুষ বসবাস করে। কিন্তু তার কিছুদিন পরে গ্রামটি প্রায় ফাঁকা হয়ে যায়। তখন হিসেব করে দেখা যায় যে মাত্র একটি পরিবার ছাড়া বাকি সবাই গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছেন। এখানে নেই কোনো বড় বাড়ি, যানবাহন। আসামের নলবাড়ী শহরের মেডিকেল কলেজ থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে এই গ্রামে যাওয়াটা বেশ কষ্টসাধ্য। কারণ গ্রামটিকে শহরের সঙ্গে সংযুক্ত করার কোনো রাস্তা নেই।বর্ধনারা ভারতের সবচেয়ে প্রত্যন্ত গ্রামগুলোর মধ্যে একটি।
রাজস্থানের জয়সলমীরের কুলধারা গ্রামের সঙ্গে বর্ধনারা গ্রামটির কিছুটা মিল আছে। জয়সলমীর থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে যে গ্রামে একটা সময় পালীবাল ব্রাহ্মণদের বাস ছিল। কিন্তু তিনশো বছর আগে সেই গ্রাম জনশূন্য হয়ে যায়। কেন সবাই গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিল তা নিয়ে নানা কথা আছে। তবে তারপর থেকে সাবার কাছে এই গ্রাম ‘ভূতের গ্রাম’ বলেই পরিচিত।যদিও কুলধারা গ্রামে অনেক পর্যটক বেড়াতে যান। বর্ধনারা গ্রামটি যদিও কুলধারার মত এখনও পুরোপুরি জনশূন্য হয়নি। বর্তমানে সেখানে বিমল ডেকা, তার স্ত্রী অনিমা এবং তাদের তিন সন্তান নরেন, দিপালী ও সেউতি বসবাস করেন। পরিবারের প্রধান বিমল ডেকার থেকে জানা যায় যে তিনি প্রায় চল্লিশ বছর ধরে এই গ্রামে বাস করছেন।বসবাসের জন্য রয়েছে একটি কাঁচা বাড়ি। ডেকা গ্রামের রাস্তার ব্যাপারে আক্ষেপ করে জানিয়েছেন যে, গত ৪০ বছর ধরে এই গ্রামে আরও কয়েকজন গ্রামবাসী ছিল কিন্তু তারা চলে যায়। স্থানান্তর করার মতো সম্পদ না থাকায় তারা যেতে পারেননি।তাদের যাতায়াত এবং নিকটতম বাজার বা অফিসে পৌঁছানোর জন্য একটি নৌকা রয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ের কর্মকর্তারা বহুবার তাদের গ্রামে এসেছেন, রাস্তার জন্য জমি পরিমাপ করেছেন কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, রাস্তাটি তৈরি হয়নি। স্থানীয় প্রতিনিধি তাদের সঙ্গে দেখাও করেননি।
এমন প্রতিকূলতা সত্ত্বেও দিপালী ও নরেন স্নাতক হয়েছে। গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি এখনও। কেরোসিনের প্রদীপের আলোয় তারা পড়াশোনা করেছে। বৃষ্টি হলে গ্রামের সব পথ-ঘাট তলিয়ে যায়। তখন নৌকাই তাদের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। তবে ডেকা অরিবার থেকে জানা যায়, ১৬২ হেক্টর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই গ্রামটির অবস্থা এত করুণ আগে ছিল না। কয়েক দশক আগে এই গ্রামে এসেছিলেন আসামের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিষ্ণুরাম মেধী। তখন তিনি একটি সংযোগ সড়ক উদ্বোধন করেছিলেন। কিন্তু গ্রামবাসীরা গ্রামছাড়া শুরু করলে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় অবস্থার আরও অবনতি হয়। জেলা পরিষদ, পঞ্চায়েত বা ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিসের মতো স্থানীয় সংস্থা এখানে কোনো উন্নয়ন কাজ করতে আগ্রহী নয়। সম্প্রতি বর্ধনারা গ্রামে গ্রাম্য বিকাশ মঞ্চ নামে একটি এনজিওর একটি কৃষি খামার স্থাপন করেছে। ফলে এখন পরিবারটি কয়েক জন নতুন মানুষের সঙ্গে কথা-বার্তা বলতে পারে। এনজিওর প্রতিষ্ঠাতা পৃথিভূষণ ডেকা বলেন, বারবার বন্যায় বিধ্বস্ত হয়ে গ্রামটি জনশূন্য হয়ে পড়েছে। সরকার যদি একটি সড়ক নির্মাণ করে মৌলিক সুযোগ-সুবিধা দেয় তাহলে এই গ্রামের কৃষি সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যায়। মানুষজন গ্রামে ফিরে আসবে।
কৃষিজমিতে চাষাবাদ এবং পশুপালন ডেকা পরিবারের আয়ের একমাত্র উৎস।যদি সরকার গ্রামে রাস্তা এবং সাধারণ কিছু প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয় তাহলে আবার গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়া লোকেরা গ্রামে ফিরে আসবেন। কারণ সরকারের থেকে মৌলিক সুযোগ-সুবিধা পেলে কৃষি সম্ভাবনা আবার বাস্তবায়িত হতে পারে। আশ্চর্যের ব্যাপার ৫০ বছর আগেও ছবিটা ছিল একেবারে অন্য রকম। বর্ধনারা তখন ছিল বর্ধিষ্ণু এক গ্রাম। স্কুল-কলেজ-হাট-বাজার-অফিস-বাড়ি, কী না ছিল! বাচ্চা থেকে বুড়ো, স্কুল পড়ুয়া থেকে অফিসযাত্রী, সব মিলিয়ে জমজমাট একেবারে। কিন্তু সেই গ্রাম এখন শ্মশানের মতো খাঁ খাঁ করছে। কোথাও জনমানব নেই। থাকার মধ্যে রয়েছে একটিমাত্র পরিবার আর সেখানকার ৫ সদস্য, আর কোথাও কেউ নেই। তাঁরা না থাকলে এই গ্রামের কী হবে, কেউ জানে না।