গত ন’মাস ধরে ভারত আর বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক এতটাই খারাপ যে কেউই কারও সঙ্গে বন্ধুরাষ্ট্রের মতো আচরণ করছে না। শেখ হাসিনার পতনের পর থেকেই দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে ধাপে ধাপে। বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের খবর ভারতের মাটিতে ছড়িয়ে যাওয়া মাত্র ভারত বাংলাদেশের নাগরিকদের ভিসা দেওয়া বন্ধ রেখেছে। চিকিৎসার জন্য যারা ভারতে আসে, তাদের পক্ষে ভিসা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। দু’দেশের মধ্যে সরাসরি বাস ও ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ হয়েছে। একই সঙ্গে ভারতজুড়ে বাংলাদেশবিরোধী প্রচার এবং সেই প্রচারে বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যমও জড়িয়ে পড়ে। এই অবস্থা ভারতের জাতীয়তাবাদী বা হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির পালে হাওয়া দিলেও তাতে ভারত কূটনৈতিকভাবে কি আদৌ লাভবান হবে? এরপরও বাংলাদেশ কেন ইউনূস-মোদি বৈঠকে জন্য আগ্রহী তা কি কেবল রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বাংলাদেশের সদিচ্ছা বা উদ্যোগ? বাংলাদেশের সঙ্গে যখন ভারতের সম্পর্ক সবচেয়ে খারাপ তখন মোদী ও ইউনূস একটি বৈঠকে বসেছেন, বলা বাহুল্য এই বৈঠক হয়েছে বাংলাদেশের আগ্রহ ও চেষ্টায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ইউনূস-মোদি বৈঠকের ফলাফল কী?
প্রসঙ্গত, দু’দেশের জনগণের মধ্যে বিরোধিতা থাকলেও সরকারের এই উদ্যোগে কোনো বিরোধিতা দেখা যায়নি। তবে ভারতের কূটনৈতিক মহলের কেউ কেউ বলেছেন, মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে মোদীর বৈঠকে বসা ঠিক হয়নি। বলা দরকার ইউনূস-মোদীর বৈঠকের প্রায় পুরো বিষয়টাই বাংলাদেশ ও ভারতের সংবাদমাধ্যম সূত্র থেকেই জানা গিয়েছে। সেখানেও দু’দেশের সংবাদমাধ্যমের খবর ও ভাষার মধ্যে পাল্টাপাল্টি লক্ষ্য করা গিয়েছে। তবে সব মিলিয়ে এটা বোঝা গিয়েছে যে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যেমন ইউনূস কিছু প্রসঙ্গ বৈঠকে তুলেছেন, ভারতের পক্ষ থেকে মোদীও কিছু বিষয় আলোচনায় তুলে ধরেছেন। তবে একথা বলা যায় যে নতুন কোনো ইস্যুই তাঁদের আলোচনায় ছিল না অথচ আমাদের আগ্রহ ছিল তাঁরা কোন কোন বিষয়ে আলোচনা করেন তা নিয়ে। মুহাম্মদ ইউনূস বৈঠকে যে প্রসঙ্গ তুলেছেন তার মধ্যে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শেখ হাসিনাকে ফেরত, সীমান্তে হত্যা বন্ধ, গঙ্গার জল ভাগাভাগি চুক্তির নবায়ন ও তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়ন। অন্যদিকে মোদী বাংলাদেশের সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
দুজনের বৈঠকে দেখা যাচ্ছে, হাসিনাকে ফেরত চাওয়া ছাড়া ইউনূস যে বিষয়গুলি আলোচনায় তুলেছেন, তার সবকটি দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা পুরোনো ইস্যু। বিশেষ করে বিভিন্ন সময়ে আশ্বাস দেওয়ার পরও ভারত সীমান্তে হত্যা বন্ধ হয়নি। তিস্তার জল ভাগাভাগি চুক্তিও বছরের পর বছর ঝুলে রয়েছে। গঙ্গার জল ভাগাভাগি নিয়ে যে চুক্তি হয়েছিল, তার মেয়াদ আগামী বছর শেষ হবে, স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশ সেটি নবায়ন করতে চায়। সীমান্তে হত্যা বা তিস্তা চুক্তির মতো সমস্যাগুলি ভারত খুব তাড়াতাড়ি সমাধান করার জন্য সক্রিয় হবে এমনটা কি বাংলাদেশের জনগণ আশা করে? এগুলি অনেক দিনের সমস্যা এবং এসব সমস্যা থাকা স্বত্বেও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক টিকে আছে বছরের পর বছর। বৈঠকের সবথেকে জরুরী বিষয় হল হাসিনাকে ফেরত দেওয়া। বাংলাদেশ কি মনে করে এই অনুরোধ ভারতের পক্ষে রাখা সম্ভব? কিন্তু মোদী হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি করেন, ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগণের কাছে বার্তা পৌঁছে দিতে তিনি বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বিশেষ করে হিন্দুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। যদিও ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে হিন্দু জনগোষ্ঠী এবং তাদের সম্পত্তির ওপর বেশ কিছু হামলার ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশ সরকারের আপত্তি হচ্ছে, যে মাত্রায় বলা ভারতে প্রচাতিত হচ্ছে, তা হয়নি। আবার এটাও ঘটনা যে হাসিনা সরকারের আমলেও নানা সময়ে দুঃখজনকভাবে সাম্প্রদায়িক হিংসতার ঘটনা ঘটেছে তখন কিন্তু ভারত সোচ্চার হয়নি মোটেও।
তবে কি মোদী-ইউনুস বৈঠকের সবটুকুই নিষ্ফলা অথবা সংখ্যালঘুদের প্রতি ভারত এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এই উদ্বেগ বাংলাদেশের মানুষের মনে প্রশ্ন জাগাবে না? প্রশ্ন, ভারতে সংখ্যালঘুদের কী অবস্থা, সবাই কী নিরাপদ? বাংলাদেশের হিন্দুদের নিয়ে যেমন ভারতের উদ্বেগ আছে, মোদির সঙ্গে বৈঠকে ইউনূস তা না তুললেও ভারতের মুসলমান বা সেখানকার সংখ্যালঘুদের নিয়ে বাংলাদেশের মানুষেরও উদ্বেগ আছে। তারা তো দেখতেই পারছেন বিজেপি সরকার সংশোধনী ওয়াক্ফ আইন করেছে তা নিয়ে ভারতের মুসলমানরাও ক্ষুব্ধ। সেখানকার মুসলমানদের অভিযোগ, মুসলিম সম্প্রদায়ের ওয়াক্ফ বোর্ডের সম্পত্তি সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিতেই এই আইন করা হয়েছে। ইউনূস-মোদী বৈঠক পরবর্তী সময়ে কূটনীতির লোকেরা বলছেন, যেকোনো গণতন্ত্রে নিয়মিত অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন খুব জরুরি একটি ব্যাপার। মোদীও ইউনুসকে এই বিষয়ে অবগত করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশে হাসিনার আমলে যে তিনটি একতরফা নির্বাচন হয় তখন ভারতের কেন মনে হলনা যে গণতন্ত্রে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ নির্বাচন দরকার?