তার পেশিশক্তির সঙ্গে গরিলার পেশিশক্তির কোনো তুলনায় হয় না| একটা ড্যাং বিটল (Dung Beetle) নিজের ওজনের ১,১৪১ গুন ওজন তুলতে পারে, রাইনোসেরস বিটলের ক্ষত্রে (Rhinoceros Beetle) তা ৮৫০ আর লিফকাটার অ্যান্ট (Leafcutter ant) তোলে নিজের ওজনের ৫০ গুন। কে এমন শক্তিশালী প্রানী? না, নীল তিমি বা অন্য কোনও হিংস্র তিমি বা হাঙর অথবা নিদেনপক্ষে আফ্রিকার হাতি, গন্ডার, গরিলা, বাইসন কিংবা মেরু ভালুক নয়| পৃথিবীর সব থেকে শক্তিশালী প্রাণীটি হল একটি বিশেষ জাতের গুবরে পোকা (Dung Beetle)| কেবল তাই নয়, সব থেকে শক্তিশালী প্রাণীদের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানেও রয়েছে আরেক জাতের গুবরে পোকাই (Rhinoceros Beetle), তৃতীয় স্থানে এক শ্রেণির পিঁপড়ে (Leafcutter ant)| স্তন্যপায়ী বা সরীসৃপরা কেউই প্রথম তিনের মধ্যে জায়গা করে নিতে পারেনি| হ্যাঁ এটা ঘটনা যে সামনাসামনি যুদ্ধে একটা গুবরে পোকা একটা তিমি বা একটা গরিলাকে হারিয়ে দেবে। একটু তলিয়ে দেখা যেতে পারে। একটি প্রাণীর শক্তি বলতে ঠিক কী বোঝায়? যে কোনও প্রাণীর শক্তি মানেই তার পেশিশক্তি| কিন্তু এক্ষেত্রে শুধু পেশিশক্তি ধরলেই হবে না, প্রাণীটির ওজনও এখানে বিচার্য| এই কারণেই পেশিশক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত যেসব খেলাধুলা রয়েছে, যেমন কুস্তি, মুষ্টিযুদ্ধ সেখানে প্রতিযোগীদের ওজনভিত্তিক বিভাগ পৃথক রাখা হয়| কারণ দু’জনের মুখোমুখি যুদ্ধে একজনের পেশিশক্তি অপরজনের তুলনায় কিছুটা কম থাকলেও যদি ওজন অনেকটা বেশি থাকে তবে সে স্রেফ ওজনের জোরেই যুদ্ধে জিতে যাবে| সে সুমো কুস্তিগিরই বলুন কিংবা জলহস্তিই বলুন, এদের দেহে পেশির তুলনায় স্নেহ-জাতীয় পদার্থ অনেক বেশি, কিন্তু স্রেফ ওজন দিয়েই এরা পেশিবহুল প্রতিদ্বন্দীকে অনায়াসে পরাস্ত করার ক্ষমতা ধরে| তাই প্রতিযোগিতায় ওজনভিত্তিক বিভাগে প্রতিদ্বন্দ্বীদের ভাগ করে দিলে নির্দিষ্ট একটি দ্বন্দ্বযুদ্ধে ওজনের সুবিধা কেউই নিতে পারছে না, যার পেশিশক্তি বা যুদ্ধের কৌশল তুলনামূলকভাবে ভালো সেই জিতবে|

এই তথ্যটা যদি আমরা বুঝে থাকি তবে এটাও নিশ্চয়ই বুঝতে পারবো যে একটা গরিলার সঙ্গে যদি একটা গুবরে পোকার যুদ্ধ হয়, তাহলে সেটা অবশ্যই একটা অন্যায় যুদ্ধ, কারণ গরিলার ওজনের তুলনায় গুবরে পোকার ওজন ধর্তব্যের মধ্যেই আসে না| তাহলে এই অন্যায় যুদ্ধটাকে একটা ন্যায়যুদ্ধে পরিণত করার উপায় কী? একটা কাল্পনিক যুদ্ধের আয়োজন করা যেখানে গুবরে পোকা আর গরিলার ওজন সমান| এর ফলাফল কী হতে পারে? আগেই বলেছি গুবরে এক ফুঁয়ে গরিলাকে উড়িয়ে দেবে। অন্যান্য সকল প্রাণীর মতো ডাইনোসরও মৃত্যুর পর ব্যাকটেরিয়া, কৃমি, পোকা ইত্যাদির সাহায্য মাটিতে বিয়োজিত হত। এদের মধ্যে পরিচিত এক পোকা হলো ‘বোন-বোরিং বিটল‘ নামে এক হাড়খেকো গুবরে পোকা। এই পোকারা মাংসের চেয়ে হাড়ের প্রতি আকৃষ্ট হয় বেশি। প্রথমে তারা মৃত ডাইনোসরের হাড়ের ছিদ্রে ডিম পাড়ত, তারপর এগুলো থেকে লার্ভা বের হয়ে তা হাড়ের পুষ্টি সমৃদ্ধ হাড়ের মজ্জা খাওয়া শুরু করত। ফলে অল্প সময়ে হাড় ভেঙে মাটির সাথে অতি সহজেই মিশে যেত। দৈহিক অনুপাতে গুবরে পোকা পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী প্রাণী। এরা এদের দেহের ওজনের ১১৪১ গুন ভারী বস্ত টেনে নিয়ে যেতে পারে। যা একজন মানুষের ৬টি ডাবল ডেকার বাস টেনে নিয়ে যাওয়ার মতো ব্যাপার!

গুবরে পোকা সর্বাধিক সংখ্যক প্রজাতিবিশিষ্ট পোকা। এরা কোলিওপ্টেরা বর্গভুক্ত; গ্রিক ভাষায় কোলিওস অর্থ আবরণ এবং টেরন অর্থ পাখা, অর্থাৎ আবরণযুক্ত পাখা, যে বর্গে প্রাণীকূলের অন্যান্য যেকোন বর্গের হতে অধিক সংখ্যক প্রজাতি বিদ্যমান, যা কিনা সকল প্রকার জ্ঞাত জীবের ২৫%। বর্ণিত হওয়া পতঙ্গের মধ্যে ৪০% হল গুবরে পোকা (প্রায় ৩,৫০,০০০ প্রজাতি), এবং প্রায়ই এর নতুন প্রজাতি আবিষ্কার হচ্ছে। ধারণা করা হয় বর্ণিত ও অবর্ণিত মিলিয়ে গুবরে পোকার সর্বমোট প্রজাতি সংখ্যা ৫০ থেকে ৮০ লক্ষ। সবচেয়ে বড় পরিবারও এই বর্গভুক্ত, সারকুলিওনিডে! গুবরে পোকা Coleoptera বর্গের একদল পোকা। প্রায় সব প্রজাতির গুবরে পোকার দুই জোড়া ডানা আছে। সামনের ডানা জোড়া শক্ত ও পুরু। সামনের জোড়া পেছনের জোড়া ও এদের উদরকে ঢেকে রাখে এবং নিরাপত্তা দেয়।

গোবর, মলমূত্র, শবদেহ, জৈব আবর্জনায় এদের বসবাস। দেখা গেছে, বিভিন্ন প্রজাতি গোবর বা মলমূত্রকেই পছন্দ করে। আবার কিছু পোকা বিভিন্ন ধরনের বিষ্ঠার মধ্যে বাস করতে অভ্যস্ত। মাটির নিচে বসবাসকারী এসব পোকা মাটির উপরিভাগের জৈব ময়লা-আবর্জনা অপসারণ করে ভূ-পৃষ্ঠ পরিষ্কার রাখার কাজে নিজেদের নিয়োজিত রাখে। গোবরে বসবাসকারী পোকগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে গোবরের দলার নিচে সরু সুড়ঙ্গপথে গোবরের ছোট ছোট টুকরা মাটির নিচে বয়ে নিয়ে যায়। গোবরের এসব অংশ তারা খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে। তাদের এ কাজ মাটির উর্বরতা বাড়িয়ে দেয়। এ ছাড়া গুবরে পোকা মলমূত্রের মধ্যে বসবাসকারী নানা ধরনের পরজীবী ধ্বংস করে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করে। কোনো কোনো পোকা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মানুষের কিছু ক্ষতিও করে। গবাদি পশুর রোগ সৃষ্টিকারী কয়েকটি পরজীবীর মাধ্যমিক পোষক হিসেবে এদের ভূমিকা আছে। কিছু পোকা বাগানের ফুলগাছ, লতাগুল্ম অথবা ফসলের ক্ষতি করে। বিজ্ঞানীদের মতে, প্রায় চার লাখ প্রজাতির বিভিন্ন ধরনের গুবরে পোকা পৃথিবীতে রয়েছে। মেরু অঞ্চল বাদে পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই দেখা যায় এদের।

এরা প্রায় সব ধরনের খাবার খায়। কিছু প্রজাতি উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশ যেমন—পাতা, ফল, বীজ অথবা গুঁড়ি খায়। আবার কিছু প্রজাতি তাদের থেকে ছোট পোকামাকড় শিকার করে খায়। স্ত্রী গুবরে পোকা ডিম পাড়ে। ডিম থেকে লার্ভা বের হয়, যাদের কোনো ডানা থাকে না। লার্ভা থেকে পিউপা পর্যায়ে এরা কোনো খাদ্য গ্রহণ করে না। পিউপা থেকে এরা পোকায় রূপান্তরিত হয়। গুবরে পোকা দেহের কেমিক্যাল নিঃসরণের মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে। পুরুষরা দৈহিক গন্ধের মাধ্যমে স্ত্রীদের শনাক্ত করে। কিছু পোকা শব্দ উৎপন্ন করে যোগাযোগের জন্য। Beetle প্রজাতির গুবরে পোকা নিজেদের ওজনের থেকে প্রায় এক হাজার ১০০ গুণ বেশি ভার বহন করতে পারে। এসব পোকা নিয়ে বিজ্ঞানীদের গবেষণা শুরু হয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে। সাম্প্রতিক এক জরিপে বাংলার বিভিন্ন স্থান থেকে ৩৫ প্রজাতির গুবরে পোকার সন্ধান মিলেছে।
