মৃত্যুর তিন সপ্তাহ আগে নেপোলিয়ন একটি উইল লিখেছিলেন। যেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘সময়ের আগেই আমি মারা যাচ্ছি, আমাকে হত্যা করেছে ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী এবং তাদের গুপ্তহত্যাকারীরা।’ তবে সুইডেনের দাঁতের চিকিৎসক ও বিষ বিশেষজ্ঞ স্টেন ফরশুফভুদ ও অন্যান্য বিজ্ঞানীরা একাধিকবার বলেছেন, নেপোলিয়নকে আর্সেনিক বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করা হয়। এরকম সন্দেহ আর বিতর্ক নেপোলিয়নের মৃত্যু ঘিরে রহস্যের আবরণ সৃষ্টি করে। রহস্য আরও ঘনীভূত হয় যখন নেপোলিয়নের এক গোছা চুলে অতিরিক্ত আর্সেনিক মেলে।
উল্লেখ্য, ১৮৪০ সাল নাগাদ ফরাসিরা মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য নেপোলিয়নের কবর খুঁড়েছিল। দেখা যায়, মৃতদেহটি টিনের কফিন ঝালাই করে বন্ধ করা, সেটি ফের মেহগনি কাঠের কফিনে ভরে লেডের আর একটি কফিনে ঝালাই করে বন্ধ। এরপর আরেকটি মেহগনি কাঠের কফিনে ভরে রূপোর স্ক্রু দিয়ে আটকানো। আশ্চর্যের বিষয় নেপোলিয়নের মৃতদেহটি তখনও পচেনি, অথচ তা রাসায়নিক পদার্থ দিয়েও সংরক্ষিতও নয়। মুখের চামড়া তখনও টানটান।
নেপলিয়নের স্মৃতি হিসাবে মৃত্যুর আগেই গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোরেন্সিক ডিপার্টমেণ্টে রাখা ছিল একগুচ্ছ চুল। ১৯৬১ সালে নিউট্রন অ্যাকটিভেশন অ্যানালিসিস করে চুলের থেকে অতিরিক্ত আর্সেনিক পাওয়া গেলে নেপোলিয়নের মৃত্যুরহস্য অন্য মাত্রা পায়। এরপর ১৯৮২ সালে বেন ভাইডার ও ডেভিড হ্যাপগুডের বই ‘দি মর্ডার অফ নেপোলিয়ন’ ব্রিটিশদের ওপর সন্দেহ আরও বাড়িয়ে দেয়।
উল্লেখ্য, বিভিন্ন সময়ে একাধিক ভাষায় নেপোলিয়নকে নিয়ে এ পর্যন্ত পাঁচ লক্ষ বই লেখা হয়েছে। হিসেবটা এরকম; নেপোলিয়নের মৃত্যুর পর প্রতি বছর তাঁর ওপর প্রায় দেড় হাজার করে বই বের হয়েছে। নেপোলিয়নের নির্বাসনের ওপর রয়েছে ২৫ হাজার বই। নেপোলিয়নকে নিয়ে লেখা সংখ্য বইগুলির লেখকদের মধ্যে আছেন সেন্ট হেলেনায় নির্বাসনকালীন তাঁর চার ঘনিষ্ঠ স্টাফ বার্ট্রান্ড, মনথলন, লেসক্যাসাস ও গোরগার্ড। এছাড়াও আছেন তার প্রধান এক ভৃত্য মার্চান্ড।
স্মৃতিকথামূলক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তীকালে লেখা বইগুলিতেও বিষ প্রয়োগে নেপোলিয়নকে হত্যা করার উল্লেখ রয়েছে। সেই বইগুলির মধ্যে যেসব লেখকের বই উল্লেখযোগ্য তারা হলেন ফরশুফভুদ (১৯৬১, ১৯৯৫), উইডার (১৯৮২, ১৯৯৫)। এছাড়াও আরও কয়েকটি বই রয়েছে যেখানে বলা হয়েছে নেপোলিয়ন ১৮২১ সালের ৫ মে মারা যাননি। বেশ কিছু বইতে সেন্ট হেলেনায় তাঁর নির্বাসন জীবনের বিস্তারিত বর্ণনা তুলে আনা হয়েছে। সেসব বইয়ের লেখকের মধ্যে আছেন কাউফম্যান (১৯৯৯) ও গিলস (২০০১)।
ধারণা করা হয়, নেপোলিয়নকে খুবই পরিকল্পিতভাবে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল। মৃত্যুর ১৯ বছর পরে ১৮৪০ সালে প্যারিসে মর্যাদাপূর্ণ শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের জন্য নেপোলিয়নের মরদেহ কবর থেকে তোলা হয়েছিল। ওই সময় নেপোলিয়নের মরদেহ তুলনামূলক বেশ ভালো অবস্থায় ছিল। কিছু বিজ্ঞানী বলে থাকেন, বিষ হিসেবে আর্সেনিক প্রয়োগের কারণেই নেপোলিয়নের মরদেহে নাকি স্বাভাবিক মাত্রায় পচন ধরেনি। ১৯৬১ সালে এক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় ধরা পড়ে যে নেপোলিয়নের চুলে অত্যধিক মাত্রায় আর্সেনিক ছিল। ২০০৮ সালে আরেক পরীক্ষায় দেখা গেছে, নেপোলিয়নের পুরো জীবনের চারটি পর্যায়েই তাঁর দেহে আর্সেনিকের উপস্থিতি অতিরিক্ত পরিমাণে ছিল। এমনকি তাঁর ছেলে ও স্ত্রীর দেহেও আর্সেনিকের উপস্থিতি বেশি ছিল।
বিভিন্ন পরীক্ষা বা গবেষণা থেকে পাওয়া উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞদের অনুমান, বহুদিন ধরে খুব সামান্য মাত্রায় নেপোলিয়নের দেহে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল। আর বিষ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল আর্সেনিক। কারণ, অল্প অল্প করে আর্সেনিক বহু দিন ধরে প্রয়োগ করা হলে তা সহজে চিহ্নিত করা যায় না। এদিকে ২০০৪ সালের এক গবেষণায় বলা হয়, সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসিত থাকার সময় নেপোলিয়নের দেহে নানা ধরনের ওষুধ প্রয়োগ করা হয়েছিল। আর সেই সব ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াতেই নেপোলিয়নের হৃদ্যন্ত্রের কাজ বন্ধ হয়ে যায়।