বাঙালির খুশীর ঈদের আনন্দের সঙ্গী হয়ে আছে ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ/ তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ’ গানটি। চাঁদ দেখতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঈদ ঘোষিত হলে বাঙালি মুসলিমদের বাড়িতে এবং মহল্লায় এই গানটি বাজতে শুরু করে। গানটি ছাড়া বাঙালি মুসলিমদের ঈদ যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। প্রায় একশো বছর ধরে এই গানটি বাঙালির ঈদ-আনন্দের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হয়ে আছে। আপামর বাঙালি মুসলিমদের মননে গেঁথে যাওয়া এই গানটি জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদের অনুরোধে লিখেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। গানটি লেখার পেছনে আছে অসাধারণ এক গল্প।

নজরুলের শ্যামাসংগীত তখন বাংলায় তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, পাশাপাশি আব্বাসউদ্দীন নজরুলের ‘বেণুকার বনে কাঁদে বাতাস বিধুর’, ‘অনেক কিছু বলার যদি দুদিন আগে আসতে’, ‘গাঙে জোয়ার এল ফিরে তুমি এলে কই’, ‘বন্ধু আজও মনে পড়ে আম কুড়ানো খেলা’ ইত্যাদি গানগুলি রেকর্ড করে সুনাম কুড়িয়েছেন। এক রাতে রেকর্ডিং শেষে বাড়ি ফিরছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। ফেরার পথে নজরুলকে আব্বাসউদ্দীন বললেন, ‘কাজীদা আপনি তো জানেন পিয়ারু কাওয়াল, কাল্লু কাওয়াল প্রমুখের উর্দু কাওয়ালি যেমন জনপ্রিয় তেমনি বিক্রি। বাংলায় ওই ধরনের ইসলামী গান তৈরি করা যায় না? আপনি তো এমনিতেই মুসলমান সমাজে কাফের হয়েছেন, যদি ইসলামী গান লেখেন তাহলে মুসলমানেরা আবার আপনার জয়গান গাইবে।’

আব্বাসউদ্দিনের কথায় নজরুল পড়লেন দোটানায়। কারণ বাজারে তখন নজরুলের লেখা ও সুর করা শ্যামা সংগীত সুপার হিট। ইসলামী ধারার গানের বাজারই গড়ে ওঠেনি তখন। এই অবস্থায় স্রোতের বিপরীতে গিয়ে কাজ করে সফল হতে না পারলে সমস্যায় পড়তে হবে। অন্যদিক ইসলামী গানের আবেগেও নজরুল যথেষ্ট দুর্বল। কিন্তু চাইলেই সেই গান রেকর্ড করে ফেলা যায় না, সরঞ্জাম ছাড়াও লাগে লগ্নি। তার জন্য গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সেল-ইন-চার্জ ভগবতী ভট্টাচার্যের সঙ্গে কথা বলে তাঁকে রাজি করাতে হবে। নজরুল আব্বাসউদ্দিনকে বললেন, ‘তুমি ভগবতীবাবুকে প্রস্তাব দিয়ে দেখ, কি বলেন তিনি। আমি ঠিক বলতে পারব না’। সেই মতো আব্বাসউদ্দীন দু-একদিনের মধ্যেই গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সাল-ইনচার্জের ভগবতী ভট্টাচার্যের কাছে হাজির হলেন। কিন্তু আব্বাসউদ্দিনের প্রস্তাব শুনে তো ভগবতী বাবু তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। এককথায় তিনি ইসলামি ধারার গানের প্রস্তাব পুরোপুরি বাতিল করে দিলেন। কারণ স্রোতের বিরুদ্ধে গিয়ে গানের রেকর্ড করে ব্যবসায় লালবাতি জ্বালাতে তিনি একেবারেই রাজি নন। অগত্যা মনের দুঃখ মনে চেপে চুপ মেরে গেলেন আব্বাসউদ্দীন।

এরপর প্রায় ছয় মাস পেরিয়ে গিয়েছে। একদিন দুপুরে ঝম ঝম করে বৃষ্টি হচ্ছে। নিজের অফিস থেকে গ্রামোফোন কম্পানির রিহার্সাল ঘরে গিয়েছেন আব্বাসউদ্দীন। সেখানে পৌঁছে তিনি দেখেন একটা ঘরে বেশ ফুরফুরে মেজাজে গল্প করছেন ভগবতীবাবু। তার খোশমেজাজ দেখে আব্বাসউদ্দীনের মনে হল, ওই প্রস্তাবটি আরেকবার পেশ করার এই তো সুবর্ণ সুযোগ। মনে হওয়া মাত্র আব্বাসউদ্দীন ঝটপট বলে ফেললেন, ‘যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে বলি। সেই যে ইসলামি গানের রেকর্ড করার কথা বলেছিলেম, আচ্ছা, একটা এক্সপেরিমেন্টই করুন না, যদি বিক্রি না হয় আর নেবেন না, ক্ষতি কী?’ জনপ্রিয় শিল্পী কে এবার আর ফেরাতে পারলেন না গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সাল-ইন-চার্জ ভগবতী ভট্টাচার্য। হেসে বললেন, ‘নেহাতই নাছোড়বান্দা আপনি, আচ্ছা আচ্ছা, করা যাবে।’ সেদিন আব্বাসউদ্দীনের ভাগ্য ছিল ভীষণ ভালো। জানতেন পাশের ঘরেই আছেন কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি তৎক্ষণাৎ গিয়ে নজরুলকে বললেন যে ভগবতবাবু রাজি হয়েছেন।

নজরুল তখন ইন্দুবালাকে গান শেখাচ্ছিলেন। খবর শুনে তিনি ইন্দুবালাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে আব্বাসউদ্দীনের জন্য গান লিখতে বসলেন। নজরুলের জন্য এক ঠোঙা পান আর চা আনিয়ে দিলেন আব্বাসউদ্দীন। তারপর দরজা বন্ধ করে আধ ঘণ্টার মধ্যেই নজরুল লিখে ফেললেন সেই বিখ্যাত গান—’ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ’। লেখা শেষ হওয়ার পর সুরসংযোগ করে নজরুল সেই গান শিখিয়ে দিলেন আব্বাসউদ্দীনকে। পরদিন আব্বাসউদ্দিনকে একই সময় যেতে বললেন নজরুল। পরদিন তিনি লিখলেন ‘ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর’। এই দুটি গান লেখার চারদিন পরে রেকর্ড করা হয়। তারও দু’মাস পরে ঈদ। আব্বাসউদ্দীনকে বলা হল, ঈদের সময় গান দুটো বাজারে বের হবে। ঈদের ছুটিতে কলকাতা থেকে বাড়ি গেলেন আব্বাসউদ্দীন। বিশ-পঁচিশ দিন বাড়তি ছুটি নিয়েছিলেন তিনি। তাই নতুন ইসলামী গান কেমন চলল, তা জানার সুযোগ পাননি। তারপর ঈদে যে গানটি বাজারে ছাড়ার কথা রয়েছে, সে কথা ভুলেই গেলেন।

ঈদের ছুটি শেষে কলকাতা ফিরে এসে ট্রামে চড়ে অফিসে যাচ্ছেন আব্বাসউদ্দীন। হঠাৎ শুনলেন ট্রামে তার পাশে বসা এক যুবক গুনগুন করে গাইছে, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে।’ শুনে একটু অবাকই হলেন আব্বাসউদ্দীন। যুবকটি এই গান শুনল কীভাবে? অফিস ছুটির পর গড়ের মাঠে বেড়াতে গিয়েও শোনেন মাঠে বসে একদল ছেলের মধ্যে একটি ছেলে গাইছে ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে।’ তখন আব্বাসউদ্দীনের মনে পড়ল এ গান তো ঈদের সময় বাজারে বের হওয়ার কথা চিল। সঙ্গে সঙ্গে তিনি গেলেন সেনোলা রেকর্ড কোম্পানীর বিভূতিদার দোকানে। আব্বাসউদ্দীনকে দেখেই বিভূতিবাবু জড়িয়ে ধরলেন। রসগোল্লা আর চা-এর সঙ্গে আব্বাসউদ্দীনের গান দুটো আর আর্ট পেপারে ছাপানো বিরাট ছবির একটা বান্ডিল সামনে রেখে বললেন, ‘বন্ধু-বান্ধবদের কাছে বিলি করে দিও। আমি প্রায় সত্তর আশি হাজার ছাপিয়েছি, ঈদের দিন এসব বিতরণ করেছি। আর এই দেখ তোমার গানের দু’হাজার রেকর্ড।’

আনন্দে নেচে উঠে আব্বাসউদ্দীন ছুটলেন কাজী নজরুলের বাড়িতে। সেখানে গিয়ে শুনলেন নজরুল রিহার্সাল রুমে গিয়েছেন। সটান সেখানে গিয়ে হাজির হলেন। তাঁর গলা শুনে লাফিয়ে উঠলেন দাবা খেলায় মগ্ন নজরুল। আব্বাসকেক বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘তোমার গান কী যে—’ হ্যাঁ নজরুলের লেখা ও সুর করা এবং আব্বাসউদ্দিনের গাওয়া বাংলা প্রথম বাংলা ইসলামী গান সেদিন সত্যি তোলপাড় করেছিল। বাংলার মুসলমানদের ঘরে ঘরে যে গান আজও খুশির ইদে বেজে ওঠে। এরপর একের পর এক ইসলামি ধারার গান লেখেন নজরুল আর রেকর্ড করেন আব্বাসউদ্দীন। বাংলা গানের ধারায় নতুন জোয়ার আসে। এভাবেই বাংলা গানের দুনিয়ায় যোগ হয় অবিস্মরণীয় গানের ধারা এবং ঈদ উদযাপনের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ।
