বেশিদিন আগের কথা নয়, ইতালির পেরুজিয়া অঞ্চলের পুলিশের কাছে একটি ফোন আসে, সাংঘাতিক একটি খুনের খবর। পুলিশ ছুটে যায় ঘটনাস্থলে, গিয়ে দেখে, মেরিডিথ কার্চার নামের একজন ব্রিটিশ তরুণী নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন। সেই তরুণী ইংল্যান্ড থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য ইতালিতে এসেছিলেন। কিন্তু তাঁকে নির্দয় খুনের শিকার হতে হল। সন্দেহের তীরে যারা ছিলেন, তাঁদের একজন মেরিডিথের আমেরিকান রুমমেট, তাঁর নাম অ্যামান্ডা নক্স। মেরিডিথ কার্চার ব্রিটেনের দক্ষিণ লন্ডনে বেড়ে ওঠা এক প্রাণবন্ত তরুণী। জাতিতে ইংরেজ হলেও ইতালিয়ান ভাষা, সংস্কৃতি, সঙ্গীত ও ইতিহাসে তার ভীষণ আগ্রহ ছিল। তাই উচ্চশিক্ষার জন্য ইতালির পাহাড়ি শহর পেরুজিয়াকে বেছে নিয়েছিলেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল ইউরোপের রাজনীতি বিষয়ে পড়াশোনা করার। নতুন ও অপরিচিত জায়গায় তিনজনের সঙ্গে এক কটেজে থাকতেন তিনি। এর মধ্যে দুজন তরুণ ইতালিয়ান আইনজীবী, আরেকজন আমেরিকান তরুণী অ্যামান্ডা নক্স।

অ্যামান্ডা নক্স আমেরিকার সিয়াটলের অধিবাসী, সুদূর পেরুজিয়াতে এসেছিলেন ইতালিয়ান সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করবেন বলে। এইজন্য আমেরিকায় থাকার সময়ই বিভিন্ন রকম চাকরি করে খরচ জোগাড় করেছিলেন। সিনেমার চরিত্রের মধ্যে হ্যারি পটার তার বিশেষ পছন্দের ছিল। মেরিডিথ কার্চারের সঙ্গে তার স্বভাবে পার্থক্য থাকলেও সম্পর্ক ভালো ছিল। অবসরে দুজনে একসঙ্গে বেড়াতে যেতেন। ক্ল্যাসিকাল মিউজিকের এক অনুষ্ঠানে দুজনে মিলে যাওয়ার পর ইতালিয়ান তথ্যপ্রযুক্তির ছাত্র রাফায়েলে সুলেচিতোর সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়। রাফায়েলে ছিলেন অ্যামান্ডার প্রিয় চরিত্র হ্যারি পটারের মতো দেখতে। পরিচয়ের পর দুজনের প্রেম হতেও বেশি দেরি হয়নি।

পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে অ্যামান্ডা নক্স ও রাফায়েলে সুলেচিতোকে দেখতে পায়। এদিকে অ্যামান্ডার বক্তব্য অনুযায়ী, আগের দিন রাতটা রাফায়েলের সঙ্গে কাটিয়ে তিনি সকালে কটেজে ফিরছিলেন। ঘরে এসে তিনি কিছু আভাস পান। বাথরুমের বেসিনে শুকনো রক্তের দাগ দেখেছিলেন। তিনি অ্যাপার্টমেন্টের ইতালিয়ান রুমমেট ফিলোমেনা রোমানেলিকে ফোন করে তার আশঙ্কার কথা জানালেন। তারা ইতালির এলিট পুলিশ ফোর্স কারাবিনিয়েরিকে ফোন করে জানালেন। তার আগেই পোস্টাল পুলিশ কটেজের কাছাকাছি উপস্থিত হয়। মেরিডিথ কার্চারের দেহ আবিষ্কারের তিন দিন পর সন্দেহের বশে পুলিশ রাফায়েলে ও অ্যামান্ডাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। প্রথমদিকে পুলিশের জেরার মুখে অ্যামান্ডা খুনের ব্যাপারে জবানবন্দী দেন। পরে অবশ্য তিনি দাবি করেন, ইতালির পুলিশ তাঁকে ভয় দেখিয়ে স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করেছিলো। এমনকি তাঁকে কোনো আইনজীবীর সঙ্গেও কথা বলতে দেওয়া হয়নি। তিনি পুলিশের বিরুদ্ধে শারীরিক আঘাত করার অভিযোগও এনেছিলেন। তার ভাষ্য অনুযায়ী, সেদিন রাতে মেরিডিথ কার্চারের ঘটনা সম্পর্কে মুখ খোলার জন্য তাকে যাবজ্জীবন জেলের হুমকী দেওয়া হয়েছিল।

২০০৮ সালের জুলাই মাসে রাফায়েলে ও অ্যামান্ডা নক্সের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে খুনের মামলা করা হয়। দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়া শেষে তাঁকে ২০০৮ সালে দোষী সাব্যস্ত করে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এদিকে মেরিডিথ কার্চারের লাশ তদন্ত করে ফরেনসিক ল্যাব রুডি গুড্ডে নামে এক দাগী অপরাধীর ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও ডিএনএ পায়। অ্যামান্ডা নক্সের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার সময় তাঁকেও গ্রেফতার করা হয়। অ্যামান্ডা পরোক্ষভাবে খুনের অভিযোগ স্বীকার করে নেয়। তাঁর কথা অনুযায়ী, মেরিডিথ যে রাতে খুন হয়, অ্যামান্ডা সে রাতে কটেজে ছিলেন না। পরে তিনি তার বক্তব্যের এই অংশ বদলে দিয়ে অ্যামান্ডাকে একরকম ফাঁসানোর চেষ্টা করে। পুলিশ অনেক তন্ন তন্ন করে খুঁজেও সেখানে অ্যামান্ডা বা রাফায়েলের ডিএনএ’র কোনো চিহ্ন পায়নি। কিন্তু পরে চাঞ্চল্যকর কিছু ঘটনা ঘটে। মেরিডিথের পরনের জামার এক কোণে রাফায়েলের ডিএনএ পাওয়া যায়। পরে মেরিডিথের রান্নাঘরে ব্যবহৃত একটি ছুরি রাফায়েলের অ্যাপার্টমেন্টে পাওয়া গিয়েছিলো। ডিটেকটিভরা যাকে হত্যার অস্ত্র হিসেবে দাবি করছিলো। ছুরিটির হাতলে মেরিডিথ ও অ্যামান্ডা দুজনেরই ডিএনএ পাওয়া গিয়েছে বলে দাবি করা হয়।

২০১১ সালের ৩ অক্টোবর ইতালির আদালত অ্যামান্ডা নক্স ও রাফায়েলে সুলেচিতোকে নির্দোষ হিসেবে মেরিডিথ কার্চার হত্যা মামলা থেকে মুক্তি দেয়। এরপর অ্যামান্ডা ইতালি থেকে আমেরিকার সিয়াটলে পাড়ি জমান। সেখানে তাঁকে বহুবার গণমাধ্যমের মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু পরে কিছু বিতর্কিত ঘটনা পরিস্থিতিকে ফের ঘোলাটে করে তোলে। ২০১৩ সালের মার্চ মাসে ইতালির সর্বোচ্চ আদালত একই মামলার কারণে অ্যামান্ডা নক্সকে আবার তলব করে। ২০১১ সালে তাঁকে ও রাফায়েলেকে মুক্তি দেওয়ার রায় অগ্রাহ্য করা হয়। অ্যামান্ডা ফের ইতালির আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে অস্বীকার করেন। ২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি ইতালির আদালত তাঁর অনুপস্থিতিতেই রাফায়েলের সঙ্গে তাঁকেও খুনের দায়ে ২৮ বছর ৬ মাসের কারাদণ্ড দেয়। ২০১৫ সালে এই খুনের মামলার শুরু থেকে শেষ পর্যালোচনা করা হয়। আদালতের উচ্চ বিভাগ ৫২ পৃষ্ঠার এক রায় দেয়। জে রায়ে পুরো তদন্ত প্রক্রিয়ার একটি বড় অংশকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করে। পুলিশের কাজের প্রক্রিয়ার তীব্র সমালোচনা করা হয়। এতে অ্যামান্ডা নক্স ও রাফায়েলে সুলেচিতোকে ফের নির্দোষ বলে রায় দেওয়া হয়। অন্যদিকে রুডি গুড্ডেকে খুনী সাব্যস্ত করে তার শাস্তি বহাল রাখা হয়।

এরপর ২০১৩ সালে অ্যামান্ডা নক্সের লেখা বই ‘Waiting to Be Heard: A Memoir’ প্রকাশিত হয়। মেরিডিথ কার্চারের নির্মম হত্যাকাণ্ড, তদন্তে অ্যামান্ডার জড়িয়ে পড়া, পুলিশের জেরা, মামলার জটিলতা ও লেখিকার ভয়ের মনস্তত্ত্ব যেখানে বিস্তারিত ফুটে উঠেছে। একজন মানুষের জীবন কিভাবে পারিপার্শ্বিক ঘটনার কারনে একরকম নরক নেমে আসে। জেখানে অমানুষিক ভয়ের মুখোমুখী হতে হয়, কিন্তু সাহস না হারিয়ে ধৈর্য ও মানসিক শক্তিতে তার মোকাবেলা করতে হয়। তবে নিজের অবস্থান নিজের কাছে পরিষ্কার থাকলে হাজার প্রতিকূল অবস্থাতেও তা অতিক্রম করা যায়। ‘Waiting to Be Heard’ বইতে বর্ণনা করা হয়েছে অভিজ্ঞতা ও মনস্তাত্ত্বিক পরিস্থিতির সমন্বয়ে স্রোতের প্রতিকূলে দাঁড়িয়ে একা অসহায়ভাবে যুদ্ধ করার এক অবিশ্বাস্য গল্প। উল্লেখ্য, অসম যুদ্ধের আখ্যান নিয়ে লেখা এই বইটি নন ফিকশন হিসেবে ২০১৩ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ বেস্ট সেলার তালিকায় স্থান করে নেয়।
