তপন মল্লিক চৌধুরী
সম্প্রতি একটি গবেষণা জানাচ্ছে, গোটা বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৩০০ মিলিয়ন টনের বেশি প্লাস্টিক সামগ্রী মানুষ তাদের দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করে। এর পাশাপাশি আরেকটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, প্রতি বছর আট মিলিয়ন(৮০ লাখ)টন প্লাস্টিক বর্জ্য নদী-নালা হয়ে সমুদ্রে এসে পড়ে। সারা বছরের এই পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে মেশার ফলে বছরে ১০ লাখের বেশি সামুদ্রিক পাখি দূষণের শিকার হচ্ছে।
২০১০ সালের ১৯ এপ্রিল পরিবেশ সংক্রান্ত একটি খবর গোটা দুনিয়াজুড়ে খুব সাড়া ফেলে দিয়েছিল। খবরটি ছিল সিটল সমুদ্র সৈকতে একটি বিশাল আকৃতির তিমিকে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। পরবর্তীতে যখন সেই তিমির মৃত্যুর কারণ নিয়ে গবেষণা করা হয়, তখন দেখা যায় তিমির পাকস্থলীতে পাওয়া গিয়েছে বহু প্লাস্টিক পদার্থ। বিজ্ঞানীরা তিমির মৃত্যুর কারণ হিসেবে তার পেট থেকে পাওয়া প্লাস্টিককেই দায়ী করেন।

এ ধরণের জলজ প্রাণীর মৃত্যু নতুন কিছু নয়। প্রায়শই আমরা সংবাদপত্রে দেখতে পাই এরকম সামুদ্রিক প্রাণীর মৃত্যুর খবর। জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে একটি ভয়াবহ তথ্যে বলা হয়- প্রতি বছর প্রায় ৮০০ প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণী সমুদ্রযানের বর্জ্য পদার্থ থেকে আক্রান্ত হয়। সে সবের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশই হচ্ছে প্লাস্টিক জাতীয় বর্জ্য, যা নিতান্তই আমাদের দায়বদ্ধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
গবেষণায় দেখা গিয়েছে, প্রায় অর্ধেক সামুদ্রিক কচ্ছপ প্রতিবছর প্লাস্টিক জাতীয় পদার্থ গলাধঃকরণ করছে, যে কারণে এদের অনেকেই মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, প্লাস্টিকদ্রব্য তাদের প্রজননেও বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ফলশ্রুতিতে এই সামুদ্রিক কচ্ছপগুলোর অস্তিত্বই বিলুপ্ত হতে চলেছে।
কেবল তাই নয়, বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, গবেষণায় অধিকাংশ মৃত সামুদ্রিক পাখির পরিপাকতন্ত্রে প্লাস্টিক কণা পাওয়া গিয়েছে। অর্থাৎ লক্ষ লক্ষ সামুদ্রিক পাখির মৃত্যুর কারণ প্লাস্টিক। বিজ্ঞানীদের ধারণা এভাবে চলতে থাকলে আগামী ২০৫০ সালে ৯৯ শতাংশ পাখির পেটে প্লাস্টিক কণা পাওয়া যাবে। প্রতিদিন হাজার হাজার পাখি সমুদ্র সৈকতে উড়ে আসে খাদ্যের আশায়, খাদ্য গ্রহণের সময় অনিচ্ছাকৃতভাবে প্লাস্টিকের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা তাদের খাদ্যনালীতে চলে যায়। শুধু তাই নয়, পাখির ছোট বাচ্চাদের পেটে প্লাস্টিক কণা চলে যায় ও অকালে মারা যায়। পাখি বিশারদরা জানাচ্ছেন, প্রতি বছর ৩০ কোটি প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়, যার ৮০ লাখ টন যায় সমুদ্রে। এর ফলে প্রতি বছর প্রায় ১০ লাখ পাখি মারা যায়।

বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, ইস্ট এশিয়ান-অস্ট্রেলিয়ান ফ্লাইওয়ে পথে পৃথিবীর প্রায় ২৫০ প্রজাতির পাঁচ কোটি পরিযায়ী পাখি চলাচল করে।এর মধ্যে ২৮টি প্রজাতিকে বিজ্ঞানীরা আন্তর্জাতিকভাবে মহাবিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
পরিযায়ী পাখিরাও প্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহ শিকার। বিশেষ করে পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে হাঁস প্রজাতিরা প্লাস্টিক দূষণের বেশি শিকার হচ্ছে। এর ফলে একদিকে মা পরিযায়ী পাখিদের জীবন যেমন বিপন্ন হচ্ছে তেমনি এদের সন্তানরাও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে অকালে।

প্লাস্টিক বর্জ্য পচনশীল নয়, প্লাস্টিক মাটিতে মিশতে বা জলে প্রায় দ্রবীভূত হতে কম পক্ষে ২০ থেকে ৫০০ বছর সময় নেয়। প্লাস্টিকের ছোট ছোট টুকরো বা কণা জলে শ্যাওলাসমেত ভাসতে থাকে। পাখি যখন শ্যাওলা বা তার থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে তখন শ্যাওলার সঙ্গে প্লাস্টিকও গিলে ফেলে। ধারালো প্লাস্টিক কণা জলে ভাসমান অবস্থায় শ্যাওলার আড়ালে ঢাকা থাকে এবং ক্ষুধার্ত পাখি খাদ্য গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে প্লাস্টিক কণা পরিপাকতন্ত্রে প্রবেশ করে এবং পরিপাকনালীর ক্ষতি করে। এ ছাড়া অনেক পাখি খাদ্য সংগ্রহ করতে অনেক সময় গভীর জলে ডুব দেয়। ওই সময় অনেক পাখি প্লাস্টিক ব্যাগ ও পরিত্যক্ত জালে আটকা পড়ে জলের ওপর আর উঠতে না পেরে মারা যায়।
প্লাস্টিকের ভয়াবহতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সম্প্রতি উত্তর মেরুর সামুদ্রিক পাখি নর্দান ফুলমারের ডিমে গবেষকেরা প্লাস্টিকের উপাদান পেয়েছেন। উত্তর মেরুর কোনো পাখির ডিমে প্লাস্টিক পাওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সমুদ্রে প্লাস্টিক দূষণের ফলে একটি বিশেষ ধরণের গন্ধ ছড়াতে থাকে, যা সামুদ্রিক পাখিদের আকৃষ্ট করে। গন্ধটা অনেকটা পচা সামুদ্রিক শ্যাওলার গন্ধের মতো। ভাসমান প্লাস্টিকের টুকরোগুলোতে লেগে থাকা প্ল্যাঙ্কটন থেকে গন্ধটি তৈরি হয়। এই গন্ধটির কারণেই প্লাস্টিককে পাখিরা খাবার ভেবে ভুল করে বলে গবেষকরা জানিয়েছেন।
6 Comments
খুব জরুরি লেখা। লেখাটিতে তথ্য পরিবেশিত হয়েছে।
দূষণ কতভাবে কিভাবে হচ্ছে তার একটা সম্যক চিত্র এই লেখাটিতে ফুটে উঠেছে, শুধু তাই নয় তার চেহাড়াটা যে কি ভয়ংকর সেটাও।
প্লাস্টিক বর্জ্য জল-স্থল সর্বত্র দূষণ ছড়াচ্ছে, সেই দূষণের শিকার কেবল মানুষ নয়, যদিও দূষণ ঘটাচ্ছে মানুষ কিন্তু মৃত্যু ঘটছে প্রকৃতি থেকে জীবের। আমরা পৃথিবীকে ক্রমশই
বিষাক্ত করে তুলছি, আর কবে সচেতন হব?
প্লাস্টিক দূষণে ক্ষতিগ্রস্ত আজ গোটা দুনিয়া, কিভাবে এবং কতখানি তা লেখক তথ্য দিয়ে যেভাবে বিশ্লেষন করেছেন তা নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই, অনবদ্য তাঁর ব্যাখ্যা এবং যুক্তিসহ।
প্লাস্টিক দুষন নিয়ে এর আগেও বেশ কয়েকটি লেখা পড়েছি, তবে লেখকের যুক্তি-ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ তুলনাহীন।
লেখাটি পড়ে মন খারাপ হল, আমাদের জীবনচর্যার কারণে আকাশ-বাতাস-নদী-সমুদ্র বিষাক্ত তো হচ্ছেই সেই সঙ্গে পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর প্রাণের মৃত্যু ঘটছে। আমরাই দায়ী
এর জন্য অথচ নির্বিকার…