কর্ণফুলী নদীর ধারেনয়াপাড়ানামেএকটিগ্রাম।সেই গ্রামে ছেলেটির জন্ম।যখন ছেলেটিই স্কুলে পড়ে তখন সে তাঁর মাস্টারমশাইয়ের ঘরের দেওয়ালে টাঙানো একজনের ছবি দেখতো, বিদ্যাসাগরের ছবি।শুনত মাষ্টারমশায়গলা ছেড়ে আবৃত্তি। নবীনচন্দ্র সেনের কবিতা। ছেলেটির ভাল লাগত সেইসব কবিতা।
ছেলেটি এরপর নয়াপাড়া গ্রাম ছেড়ে পড়তে আসে চট্টগ্রাম শহরে। সেই সময় তাঁর হাতে আসে সখারাম গণেশ দেউস্করের ‘দেশের কথা’,বঙ্কিমের ‘আনন্দমঠ’ প্রভৃতি বই। সেগুলিছেলেটি মন দিয়ে পড়ে।এরপর স্কুল শেষ হয়।ছেলেটি এসে ভরতি হয় ভাগীরথীর তীরে কৃষ্ণনাথ কলেজে। সেখানে পড়ানো হত উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ, গিবন-এর ‘দি ডিক্লাইন অ্যান্ড ফল অব দ্য রোমান এম্পায়ার’।ছেলেটি পড়ত ড্যানিয়েল ব্রিন-এর ‘মাই ফাইট ফর আইরিশ ফ্রিডম’। ছেলেটির পড়তে ভাল লাগত আয়ারল্যান্ডে বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাস, বিপ্লবী জন মিচেলের আত্মত্যাগের কাহিনি। পড়ার পাশাপাশি ছেলেটি বন্ধুদের সঙ্গে ছুটে যেত বন্যাবিধ্বস্ত এলাকায়। ঝাঁপিয়ে পড়েত বন্যাত্রাণে।
পড়াশুনা শেষ করে ছেলেটি এরপর শিক্ষক হিসাবে যোগ দিলেন উমাতারা উচ্চ বিদ্যালয়ে। ছাত্রদের মুখে মুখে হয়ে উঠলেন ‘মাস্টারদা’। তখন দেশজুড়ে ইংরেজ বিরোধী হাওয়া বইছে। ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী আন্দোলনের উত্তাপ কোথায় কেমন তানিজের চোখে দেখবেন বলে মাস্টারদা বেরিয়ে পড়লেন।প্রথমে আসাম তারপর উত্তরপ্রদেশ বেশ কয়েক মাস ঘুরলেন। তখন সেখানকার পরিস্থিতি অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়েছে।ফিরে এলেন কলকাতার ওয়েলিংটন স্কোয়ারের গোপন আস্তানায়।শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’সেই সময় ‘ভারতী’তে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে।মাস্টারদা গুপ্ত আস্তানায় হ্যারিকেনের আলোয় রাত জেগে পড়তেন সেই লেখা। একদিন গ্রেফতার হয়ে চালান হয়ে গেলেন রত্নগিরি জেল। সেখানেওমাস্টারদাশরৎচন্দ্রের‘পথের দাবী’-র কথা খুব বলতেন। এও বলতেন, মহৎ সাহিত্য মনকে সজীব রাখে।এ সব বই ভালর প্রতি লোভ জন্ম দেয়।

ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি ইন্ডিয়ান পেনাল কোড ১২১/১২১এ ধারা অনুযায়ী সূর্যসেনের বিরুদ্ধে স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের মামলায় মাষ্টারদাকে ফাঁসিতে ঝোলায়। তার আগে ব্রিটিশ পুলিশ আঘাতে আঘাতে মাষ্টারদা’র সব দাঁত উপড়ে নিয়েছিল। আসলে ব্রিটিশ ফাঁসি দিয়েছিল মাষ্টারদার রক্তাক্ত ক্ষত-বিক্ষত অচৈতন্য দেহ।
ব্রিটিশ সূর্য সেনকে কনডেম্ড সেলে কড়া পাহারায় রাখতে বাধ্য হয়েছিল। সেখান থেকেও মাষ্টারদা কয়েদি মেথর মারফত জেলের বিভিন্ন ওয়ার্ডে বন্দী বিপ্লবীদের কাছে চিঠি পৌঁছে দিতেন।জেলে মাষ্টারদার একদিন গান শোনার খুব ইচ্ছা হয়। তাঁর সঙ্গে অন্য সেলে ছিলেন বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী, মেয়েদের সেলে ছিলেন কল্পনা দত্ত। একদিন রাত ১১টা/১২টা নাগাদ কল্পনা দত্ত বিনোদবিহারীর উদ্দেশে চিৎকার করে বলেন,‘বিনোদ শুনতে পাচ্ছিস, দরজার কাছে আয়। ওরে মাষ্টারদাগান শুনতে চাইছেন রে’। বিনোদবিহারী গান জানতেন না। তাহলে কি মাষ্টারদার ইচ্ছে পূরণ করা যাবে না। শেষ পর্যন্ত ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে” গানটা গেয়ে শোনালেন বিনোদবিহারী।
মৃত্যুর আগে বিপ্লবী কালীকিঙ্কর দে-কে মাষ্টারদা পেন্সিল দিয়ে একটি চিঠি লিখেছিলেন-‘আমার শেষ বাণী-আদর্শ ও একতা’। মাষ্টারদা স্মরণ করেন তাঁর স্বপ্নের কথা–স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন, যার জন্য জীবনভর তিনি অদম্য উৎসাহে; অক্লান্ত ভাবে পাগলের মতো ছুটেছেন। তাঁর নিজের ভাষায়‘ ভারতের স্বাধীনতার বেদীমূলে যে সব দেশপ্রেমিক জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের নাম রক্তাক্ষরে অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে লিখে রেখো’। সংগঠনে বিভেদ না আসার জন্য মাষ্টারদা একান্ত ভাবে আবেদন করেছিলেন।
শেষ চিঠিতে মাষ্টারদা লিখেছিলেন- আমার মাথার ওপর ফাঁসির দড়ি ঝুলছে। মৃত্যু আমার দরজায় করাঘাত করছে। মন আমার অসীম শূন্যার দিকে ছুটে চলেছে। এই তো আমার সাধনার সময়। এই তো আমার মৃত্যুকে পরম বন্ধু হিসেবে আলিঙ্গন করার সময়, হারানো দিনগুলিকে নতুন করে স্মরণ করার এই তো আসল সময়।
কত মধুর তোমাদের সকলের সঙ্গে দিনরাত কাটানোর স্মৃতি। তোমরা আমার এই জীবনের একঘেয়েমিকে তোমাদের মধুর সঙ্গ দিয়েভুলিয়ে দিয়েছ। আমাকে উৎসাহ দিয়েছ। আমাকে অক্লান্ত রেখেছ। এই সুন্দর পরম মুহূর্তে আমি তোমাদের জন্য দিয়ে গেলাম স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন। আমার জীবনের এক শুভ মুহূর্তে এই স্বপ্ন আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। জীবনভর উৎসাহভরে ও অক্লান্তভাবে পাগলের মতো সেই স্বপ্নের পেছনে আমি ছুটেছি। জানি না কোথায় আজ আমাকে থেমে যেতে হচ্ছে। লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগে মৃত্যুর হিমশীতল হাত আমার মতো তোমাদের স্পর্শ করলে তোমরাও তোমাদের অনুগামীদের হাতে এই ভার তুলে দেবে, আজ যেমন আমি তোমাদের হাতে তুলে দিয়ে যাচ্ছি।
আমরা বন্ধুরা এগিয়ে চল, কখনো পিছিয়ে যেও না। পরাধীনতার অন্ধকার কিন্তু ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। স্বাধীনতার নবারুণ দেখা যাচ্ছে। তাই হতাশ হয়ো না। সাফল্য আমাদের হবেই। মৃত্যু নিশ্চিত জেনে হয়ত তিনি কষ্ট পাচ্ছিলেন, জীবনের মায়া তাকে হয়ত আরও জড়িয়ে ধরছিল, কিন্তু সেই মুহুর্তেও তিনি তাঁর দেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন থেকে এক বিন্দু সরে যান নি, সঙ্গীদের সেই স্বপ্নে বিভোর থাকতে অনুরোধ করেছিলেন।