গত ৫ অক্টোবর থেকে ধর্মতলায় ধর্ণামঞ্চ বেঁধে জুনিয়র ডাক্তাররা ‘আমরণ অনশন’-এ বসেছিলেন। ওই দিনই উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে ‘আমরণ অনশন’-এ বসেন আরও দু’জন। অনশনে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে ভরতি করা হয়। সোমবার ১৭ দিনের সেই ‘আমরণ অনশন’ তুলে নেওয়া হল। প্রশ্ন ৭০ দিন পেরিয়ে যাওয়া আরজি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন কী থেমে গেল? সোমবার নবান্নে বৈঠকের পর জুনিয়র ডাক্তারেরা অনশন এবং পরের দিন থেকে সর্বাত্মক ধর্মঘট প্রত্যাহার করে জানান, সরকার বা প্রশাসনের কথায় কিংবা আলোচনায় প্রেক্ষিতে নয়, তাঁদের এই সিদ্ধান্ত নির্যাতিতার মা-বাবার আবেদনকে সম্মান জানাতে এবং রাজ্যেবাসির কথা ভেবে। তাঁরা এও দাবি করেন, অনশন উঠলেও আন্দোলন জারি থাকবে। আগামী শনিবার আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে ‘মহাসমাবেশ’-এর আহ্বান করেছেন জুনিয়র ডাক্তারেরা।

প্রসঙ্গত, দুনিয়ার ইতিহাসে অনশনের স্থান যথেষ্ট সহানুভূতিশীল। দাবি আদায়ে রাজনৈতিক কিংবা মানবিক অথবা সামাজিক কারণে যে বা যারা অনশন করুক, সাধারণ মানুষ সমর্থন দিয়ে এসেছে। কারণ, অনশনে অনশনকারি ছাড়া অন্য কারোর ক্ষতি করা হয় না। ফলে মানুষের বিশ্বাস যে অনশনকারী নিজের জন্যে আন্দোলন করছে না। ইতিহাস থেকে জানা যায়, যীশুখ্রিস্টের জন্মের আগে প্রথম অনশন নাকি হয়েছিল আয়ারল্যান্ডে। সে দেশের ভাষায় ‘সেলাশ’। বিচার পেতে অভিযুক্তের বাড়ির দরজায় খালি পেটে বসে থাকতেন সে দেশের মানুষ। বোধিলাভের জন্য গৌতম বুদ্ধ অনশন করেছিলেন। তবে এদেশে অনশনকে আন্দোলনের হাতিয়ার বানিয়ে ব্রিটিশ আমলে ২০ বার অনশনে বসেছিলেন মহাত্মা গান্ধী। ভারতের ইতিহাসে বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে যতীন দাসের টানা ৬৩ দিনের অনশন এবং ভগত সিং-এর অনশন। এদেশের ইতিহাসে অবশ্য লেখা থাকবে শর্মিলা চানুরও নাম। সিঙ্গুরে কৃষকদের জমিতে কারখানা তৈরির প্রতিবাদে ক্ষমতায় থাকা বামেদের ওপর চাপ তৈরি করতে একটানা ২৬ দিন অনশনে বসেছিলেন আজকের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আসলে অনশনে বসলে সর্বস্তরের মানুষের সহানুভূতিই পাওয়া যায়। একথা বলাই যায় যে জুনিয়ার ডাক্তারদের কর্মবিরতির সময়ে যত মানুষ তাঁদের আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন, তার চেয়ে বেশি মানুষ অনশনে বসার পর পাশে এসেছেন। যদিও তৃণমূল নেত্রী বা তাঁর সরকার মোটেও সহানুভূতিশীল হন নি, নেতা মন্ত্রীরা হুমকি, কুৎসিত মন্তব্য চালিয়েছেন নাগাড়ে। পুলিশ সেই অনশন ঘিরে নানা ধরনের অনৈতিক বাধা সৃষ্টি করেছে, এমনকি মুখ্যমন্ত্রী নিজেও অনশন মঞ্চের অনতিদূরে কার্নিভালে মেতেছিলেন।

কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী আন্দোলনকারী জুনিয়ার ডাক্তারদের সঙ্গে তাঁদের ১০ দফা দাবি নিয়ে আলোচনায় বসেন। এই প্রথম নয়, ২০১৪ সালের হোক কলরব আন্দোলনেও তিনি শেষপর্যন্ত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে দেখা করেন এবং তৎকালীন উপাচার্যকে সরিয়ে দেওয়ার ঘোষণা করেন আর তারপর আন্দোলনও শেষ হয়। ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে স্কুলশিক্ষকের চাকরির দাবিতে প্রেস ক্লাবের সামনে অনশনে বসে থাকা চাকরি প্রার্থীদেরে কাছেও গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী, একবার নয়, দু’বার, গিয়েছিলেন আন্দোলন দমন করতে না পেরে নিরুপায় হয়ে এবং আন্দোলন তুলে নেওয়ার সবিনয় অনুরোধ নিয়ে। বারবার বৈঠক ভেস্তে যাওয়া, নিস্ফল হওয়া ইত্যাদি টালবাহানার পরে মুখ্যমন্ত্রী যে নবান্নে জুনিয়র ডাক্তারদের বৈঠকে ডেকেছিলেন তা কী সহানুভূতিশীল হয়ে? না, অনন্যোপায় হয়ে। কারণ, গত ১৬ সেপ্টেম্বরের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী অনেক কথা বলেছিলেন, এমনকি সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশের পরেও ডাক্তাররা একাধিক হাসপাতালে আক্রান্ত হন। বাধ্য হয়েই তাঁরা অনশনের পথ বেছে নিয়েছিলেন। তাহলে আমরা বুঝবো কী? মুখ্যমন্ত্রী সমাধান করতে বৈঠকে ডাকেন নাকি ধমক দিয়ে থামিয়ে নিজেই বলে চলেন? একে কোন ধরনের আলোচনা বলবো, নাকি ধামাচাপা দিতে আলোচনা ধরে নেব? ২০১৯ সালে লোকসভার ভোট মিটলেই চাকরি হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী শিক্ষক পদপ্রার্থীদের ২৯ দিনের অনশন প্রত্যাহার করিয়েছিলেন, তাঁদের কতজন আজ চাকরি করছেন? অধিকাংশই আজও সেই তিমিরেই রয়েছেন।

অতএব ভাবাটা যতই অমানবিক হোক না কেন মুখ্যমন্ত্রী বা তাঁর সরকারের কাছে মানবিকতা আশা করাটা একেবারেই অর্থহীন। যিনি বারংবার ধর্ষণ-খুনের মতো মর্মান্তিক এবং বীভৎস ঘটনাকে ছোটখাট ঘটনা বা অন্য নানা কথায় উড়িয়ে দেন, গুরুত্বহীন করে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন, তিনি আজ হঠাৎ কী কারণে মানবিক হয়ে উঠবেন? তিনি তো জুনিয়ার ডাক্তারদের আমরণ অনশনে বসার সিদ্ধান্তকে অবহেলা করেছেন, উপেক্ষা করেছেন, তাঁর দলের নেতা-কর্মীদের কুৎসিত মন্তব্যের প্রসঙ্গে না যাওয়াই ভালো। অন্যদিকে যতদিন জুনিয়ার ডাক্তারেরা কর্মবিরতি চালু রেখেছিলেন, ততদিন তবু তাঁদের গণশত্রু হিসাবে দাগিয়ে দিয়েছেন, কারণ সরকারি হাসপাতালে কাঠামোগত ত্রুটি আড়াল করতে গরিব মানুষ পরিষেবা পাচ্ছেন না, তার পুরো দোষটা ওঁদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া সহজ হচ্ছিল। এই আন্দোলনের পিছনে বেসরকারি হাসপাতালের ডাক্তারদের মদত কাজ করছে– এই ষড়যন্ত্রের তত্ত্বও বাজারে চালানোর চেষ্টা হচ্ছিল। কিন্তু কর্মবিরতি তুলে নিয়ে শেষ অস্ত্র অনশন প্রয়োগ হতেই একটু চিন্তায় পড়তে হয়। অনশনে একজন ডাক্তারও যদি মারা যায় তাহলে সরকার দায় এড়িয়ে বিপদমুক্ত হতে পারবে না। তবে একথাও সত্য যে নির্মম শাসক একের পর এক জুনিয়ার ডাক্তার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরও মানবিকতা নয়, শুধু হুমকি, অসভ্য মন্তব্যই করে গিয়েছে আর ফন্দি এঁটেছে কিভাবে ধামাচাপা দেওয়া যায়। তাহলে কী জুনিয়ার ডাক্তারদের লড়াইতে উদবুদ্ধ সাধারণ মানুষের সমর্থন, গণজারণ, সব মিথ্যা, অপ্রাসঙ্গিক? তা কেন হবে, শাসক বা তার দলের কাছে যাই মনে হোক না কেন, এই আন্দোলন আমাদের অনেক কিছুই শেখালো এবং দেখালো। এই আন্দোলন না হলে অনেক কিছুই জানা এবং বোঝা বাকি থেকে যেত। তবে খুব অপ্রিয় হলেও একথা আজ খুব সত্যি যে ভোট ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে ন্যায়-অন্যায় বিচার আমাদের গণতন্ত্র থেকে উধাও হয়ে গিয়েছে। তা নাহলে শাসক দলের জেল ফেরত নেতাও বুক ফুলিয়ে বলতে পারেন, ওরা ভোটে জিতে প্রমাণ করুক যে মানুষ ওদের পক্ষে।
