দিনটি ছিল ১৯১৯ সালের ২৭ অক্টোবর; সোমবার। লিভারপুল থেকে ছেড়ে আসা অর্ডুনা নামের জাহাজ নিউ ইয়র্ক পৌঁছানোর পর দেখা গেল যাত্রীদের সবাই আছেন, শুধু মেরি ইম্প্রেস ছাড়া। এক-দুবার নয়, তিনবার খোঁজা হলো পুরো জাহাজ। কিন্তু তাঁর কোনও অস্তিত্বই পাওয়া গেল না। ওই জাহাজে সেই যাত্রায় সবচেয়ে আলোচিত যাত্রী ছিলেন মেরি এম্প্রেস। কারণ তিনি সেই সময়কার নির্বাক চলচ্চিত্রের একজন জনপ্রিয় অভিনেত্রী। ‘দ্য গার্ল হু ডাজেন্ট নো’, ‘দ্য স্টাববর্ননেস অব জেরাল্ডিন’, ‘দ্য ওম্যান পেইস’, ‘বিহাইন্ড ক্লোজড ডোরস’ ইত্যাদি চলচ্চিত্রে তাঁর অভিনয় নিয়ে তখনকার পত্রপত্রিকায় রীতিমতো চর্চা হচ্ছে।
মেরি এম্প্রেস এরপর সংবাদ মাধ্যমে শিরোনাম হলেন রহস্যময়ভাবে হারিয়ে গিয়ে। এই খবর গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগল না। এত মানুষের মাঝখানে তিনি কখন, কীভাবে উধাও হয়ে গেলেন, সেই রহস্যের সমাধানে তদন্তে নামলেন গোয়েন্দারা। শোরগোল পড়ে গেল চারদিকে।জাহাজের এক স্টুয়ার্ডেসের বয়ান থেকে জানা গেল, আগেরদিন এম্প্রেসের কেবিনে খাবার নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তারপরও কেবিন পরিষ্কার করতে ফের একবার গিয়েছিলেন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায়। তখন মেরি এম্প্রেস ওই স্টুয়ার্ডেসকে রাত সাড়ে নটায় স্যান্ডউইচ দিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু রাতে স্যান্ডউইচ নিয়ে কেবিনে ঢুকে তিনি মেরি এম্প্রেসকে দেখতে পাননি। ফলে স্যান্ডউইচটি রেখে ওই স্টুয়ার্ডেস বেরিয়ে আসেন। পরের দিন সকালে যখন তিনি কেবিনে আসেন, তখন দেখেন, খাবার যেমন রেখে গিয়েছিলেন তেমনই পড়ে আছে। কেবিনের বিছানাও ছিল পরিপাটি।
বিদেশি এক সাংবাদিক ওই ঘটনার পর গোটা জাহাজ বিশেষ করে মেরি এম্প্রেসের সেই কেবিন ‘স্টেটরুম ৪৮০’ ঘুরে দেখেছিলেন। তিনি জানান, কেবিনে গিয়ে তিনি দেখেন, বার্থের উপরের তাকে রয়েছে মেরি এম্প্রেসের বেশ কয়েকটি ছবি, সম্ভবত মেরি এম্প্রেস সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের দেওয়ার জন্যই আলাদাভাবে রেখেছিলেন। ওই সাংবাদিকের থেকে পাওয়া তথ্য এও জানায়, মেরি ইম্প্রেসের কেবিনে ইন্টারিয়র প্যাসেজওয়ের একটি দরজা ছিল যেটি খুব বেশি হলে ১৩/১৪ ইঞ্চি চওড়া। কিন্তু সেই দরজা বা প্যাসেজ দিয়ে কোনও মানুষের পক্ষেই বেরনো সম্ভব নয়। তাছাড়া সেই দরজা ভেতর থেকেও বন্ধ করা ছিল। কিন্তু মেরি ইম্প্রেস ওই দরজা বা প্যাসেজ দিয়ে কেনই বা বেরতে যাবেন। তাহলে কী করে তিনি জাহাজ থেকে বেমালুম উধাও হয় গেলেন? এছাড়া নিউ ইয়র্ক পৌঁছানোর কয়েকদিন আগে তিনি সেখানকার একটি হোটেলে টেলিগ্রাফ করেছিলেন। সেটিও পরবর্তীতে পাওয়া যায়। তাতে স্পষ্ট করেই লেখা আছে, “সোমবার আসছি। আমার জন্য একটা রুম রাখবেন।”
মেরি ইম্প্রেসের আশ্চর্যজনক নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া নিয়ে গোয়েন্দারা নানাভাবে তদন্ত চালিয়েছিলেন। সম্ভাব্য যা যা ঘটতে পারে সবই প্রায় তলিয়ে দেখা হয়েছিল বলে জানা যায়। তদন্তের রিপোর্টে বলা হয়, মেরি এম্প্রেসকে সেই স্টুয়ার্ডেস সাড়ে ছয়টায় দেখে থাকলেও সাড়ে নয়টায় গিয়ে আর দেখতে পাননি। সন্ধ্যার ওই সময়ে জাহাজের ডেক ছাড়াও প্রায় সব জায়গাতেই যাত্রীদের আনাগোনা যেমন লেগে থাকে সেদিনও তেমন ছিল। মেরি এম্প্রেস যদি কেবিনের মূল দরজা দিয়ে বেরিয়ে জাহাজের ধারে যেতেন তাহলেও কোনও না কোনও যাত্রী, স্টুয়ার্ট বা অফিসারদের পাশ দিয়েই তাঁকে যেতে হত। সেক্ষেত্রে কারও না কারও নজরে পড়তেন। কেউ তাঁকে লক্ষ্য করলো না; এটা ভাবা প্রায় অসম্ভব। কারণ তার মতো সুন্দরী ও খ্যাতনামা একজন অভিনেত্রী কেবিন থেকে বের হলে কারও চোখে পড়বেন না, তা কি করে সম্ভব। তাহলে মেরি এম্প্রেস কিভাবে উধাও হলেন?
যে সময় থেকে তিনি জাহাজ থেকে নিখোঁজ হন, তখনও পর্যন্ত জাহাজের ডেক এবং বার রুমগুলি জ্বলজ্বল করেছে। তাই তিনি যে অন্ধকারে উধাও হয়েছেন এটাও বলা যাবে না। তবে সেই স্টুয়ার্ডেস জানিয়েছেন, সমুদ্র যাত্রাকালে মেরি এম্প্রেস পুরোপুরি কালো পোশাক পরেছিলেন আর তাঁর মাথায় ছিল টুপি। জাহাজের সহযাত্রীরাও মেরি এম্প্রেসকে কালো পোশাকেই দেখেছিলেন বলেই জানান। তারা আরও বলেন, তারা প্রায়শই তাকে একরঙা কাপড়ে দেখতেন। তবে যাত্রীদের অভিমত, তাঁকে কখনও গম্ভীর বা চিন্তিত মনে হয়নি।