এক নজরে

মহালয়া মানে এখনও রেডিও আর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র

By admin

September 13, 2020

বেশ কয়েক বছর ধরে টিভি তে ‘মহালয়া’ শুরু হয়েছে। নামি বাংলা সিনেমার অভিনেত্রীরা সেই সব মহালয়া অনুষ্ঠানে দূর্গা সেজেছেন। পিতৃ পক্ষের শেষ আর দেবী পক্ষের শুরুতে স্টার জলসা, জি বা কালার্স বাংলার মত টিভি চ্যানেলে অসুরের সঙ্গে দুর্গার ভয়াবহ যুদ্ধে বাংলা তথা ভুভারত কেঁপে উঠেছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর মহালয়াকে টক্কর দিতে পারেনি। এই সমস্ত চ্যানেলগুলোর প্রচেষ্টাকে এতটুকু ছোটো না করেই এই কথা বলছি। এমনকি আকাশবাণী একবার নতুন কার ও কে দিয়ে মহালয়ার অনুষ্ঠান করাবে বলে খ্যাতনামা শিল্পীদের দিয়ে একটি অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে। “দেবী দূর্গতিহারিনি” নাম দেওয়া হয় সেই অনুষ্ঠানের। বাঙালির কাছে সেটা উত্তমকুমারের মহালয়া নামে খ্যাত। এই অনুষ্ঠানে উত্তম কুমার, বসন্ত চৌধুরী, লতা মঙ্গেশকর ছাড়াও তাবড় তাবড় টলিউডের তারকা ছিলেন। অনুষ্ঠানের আগে খবরের কাগজে অনেক লেখালেখিও হয়, বিজ্ঞাপন ও দেওয়া হয়। কিন্তু সেই অনুষ্ঠান সম্প্রচারের পর বাঙালি একেবারেই তা নিতে পারেনি। বিক্ষোভ এমনি হয়েছিল যে ষষ্ঠীর দিন আবার রেডিও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র মহাশয়ের “মহিষাসুরমর্দিনী” সম্প্রচার করতে বাধ্য হয়। তার এই কালজয়ী কণ্ঠ ছাড়া বাঙালির দুর্গাপূজা অসম্পূর্ণ।

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র বলতেই বাঙালির মনে প্রথমেই তার চণ্ডীপাঠের কথা মনে আসে। তার এক সাক্ষাৎকারে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন , ” সেভেন না এইট এ পড়ি মনে নেই । টাইফয়েড হয়েছিল। বাড়িতে সবথেকে পছন্দের জিনিসটা ছিল রেডিও। সে বছরও হই হই করে উঠে পড়েছিলাম। বাড়ির সবার সঙ্গে। একটু দুর্বল লাগছিল। তাও মহিষাসুরমর্দিনী শুনেছিলাম। মনে হয়েছিল মা আসছেন । সব ঠিক হয়ে যাবে। দ্বিজেন মুখোপাধ্যায এর ‘ জাগো তুমি জাগো ‘ এখনও শুনলে গায়ে কাঁটা দেয়।” সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় জানালেন ” বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠই সবথেকে ভালো লাগে এখনও। টিভি তে মহালয়া দেখি কিন্তু মহিষাসুরমর্দিনী ছাড়তে পারি না।” পন্ডিত অজয় চক্রবর্তী এখনও মহিষাসুরমর্দিনী শোনেন সময় পেলেই ।” মহালয়া এমন এক অনুষ্ঠান যা আমাদের মা কে শ্রদ্ধা করতে আর ভালবাসতে শেখায়। প্রায়ই শুনি। এখনও। ” সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছোটবেলা থেকে শুনে আসছেন মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠান। এখন বয়সের জন্য সকালে আর ওঠা হয় না তার। কিন্তু অবশ্যই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়া আনন্দ দেয় তাকে। পরান বন্দোপাধ্যায় ছোটবেলা সকাল সাড়ে তিনটে থেকে উঠে বসে থাকতেন মহালয়ার অনুষ্ঠান শুনবেন বলে। ” বাড়িসুদ্ধ লোক সকালে উঠে দরজা জানলা সব খুলে দিত। বীরেন্দ্রকৃষ্ণর চণ্ডীপাঠ আকাশে বাতাসে গুঞ্জরিত হতো। শিউলি ফুল, পুজোর কেনাকাটা … সে এক ভারী আনন্দের সময় ছিল । “

বীরেন্দ্রকৃষ্ণর গলায় স্তোত্র পাঠের কথা বললেই আপামর বাঙালির মনে গুঞ্জরিত হয়” যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতানমস্তশই নমস্থশই নমস্থসইনমঃ নমঃ

অনেকে বলেন ছোটবেলা ডিপথেরিয়া না হলে নাকি বীরেন্দ্রকৃষ্ণর গলায় এই হাস্কি টোন পেত না বাঙালি। এটা অনেকটা তার কাছে ব্লেসিং ইন ডিসগাইস বলা যায়। মহিষাসুরমর্দিনী প্রথমদিকে সরাসরি সম্প্রচার করা হত। কিন্তু পরে মানুষের এত ভালোবাসা পায় এই অনুষ্ঠান যে প্রতিটি মহালয়ায় তা সম্প্রচারিত হয়ে চলেছে। শোনা যায় আকাশবাণীতে এই অনুষ্ঠান সম্প্রচারের আগে ধুপ ধুনো দিয়ে পুজোর এক পরিবেশ তৈরি করা হত। আকাশবাণী সাজানো হতো ফুল দিয়ে। গঙ্গাস্নান সেরে শ্বেত বস্ত্র পরে আসতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। এক আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডলের মধ্যে শুরু হত গান ও চণ্ডীপাঠ। উত্তর কলকাতার রামধন মিত্র স্ট্রিটের বাড়িতে রাত দুটোর সময় আসত আকাশবাণীর গাড়ি। তুলে নিয়ে যেত বীরেন্দ্রকৃষ্ণকে। সেই বাড়ি এখনও আছে। বাড়ির ফলকে খোদাই করে লেখা , ” স্বর্গীয় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।” তার নিচে লেখা কয়েকটি লাইন” এই বাড়িতেই আমৃত্যু বাস করেছেন বেতারে মহিষাসুরমর্দিনীর সর্বকালজয়ী অন্যতম রূপকার এই সুসন্তান ।”

শুধু বাড়ির ফলকে বেঁচে নেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। তিনি আপামর সাধারণ মানুষের মনে এখনও সমান শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার জায়গা নিয়ে জীবিত।