সোনায় মোড়া শহর ‘এল ডোরাডো’। ইনকা সভ্যতার সেই আশ্চর্য গোল্ডেন সিটির হাতছানি কত মানুষের যে ঘুম কেড়ে নিয়েছিল তার ইয়ত্তা নেই। সমুদ্র পাহাড় ডিঙিয়ে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে ছুটে এসেছিল কাতারে কাতারে দুঃসাহসী অভিযাত্রীর দল। তাদের কেউ কেউ এসেছিল ইতিহাস আর এডভেঞ্চারের টানে, আবার কেউ কেউ নিছক সোনার লোভে। অজস্র গুঞ্জন, কানাঘুষো আর গালগল্পের আড়ালে আজও অধরাই থেকে গেছে সূর্যদেবতার শহর এল ডোরাডো। তাকি কেবলই মিথ, কিংবদন্তি না ঘোর বাস্তব— জানা যায়নি আজও। ঠিক যেমন জানা যায় না গ্রিক পুরাণের সেই অমিতশক্তিশালী দ্বীপরাষ্ট্র আটলান্টিসের কথা। পৃথিবীর বুক থেকে কীভাবে হারিয়ে গেল প্লেটো-বর্ণিত সেই শহর? তা কি বাস্তবে ছিল, না উর্বর মাথার কল্পনামাত্র? এর উত্তর আজও খুঁজে চলেছেন অভিযাত্রী আর ঐতিহাসিকেরা।

প্রাচীন মিশরের পুরাণ ঘাঁটলেও পাওয়া যায় এমনই এক অজানা শহরের কথা। আশ্চর্য সমৃদ্ধ সেই নগরের ঠিক মাঝখানে শোভা পেত দেবতা আমুনের সুবিশাল মন্দির। গমগম করত রাজপথ, দোকানপাট। বিদেশি বণিকদের আনাগোনা লেগে থাকত ফেরিঘাটে। উৎসবমুখর, সুস্থ হাসিখুশি মানুষজনে ভরা সেই নগর একদিন আচমকা ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে গেল। কী হল, কোথায় গেল কেউ জানল না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষজন ভুলে গেল সেই নগরীর গল্প, ভুলে গেল তার অতীত গৌরবগাথা। আদপে মিশরের বুকে অমন একটা শহর ছিল কি না, সেটাই হয়ে দাঁড়াল এক মস্ত প্রশ্নচিহ্ন। মিশর ইতিহাসের সেই রহস্যেঘেরা পৌরাণিক শহর হেরাক্লিয়ন। আজ আমরা শুনব ইতিহাসের কালগর্ভে হারিয়ে যাওয়া সেই ঐতিহ্যবাহী বন্দর-নগরীর গল্প।

হেরাক্লিয়ন, প্রাচীন মিশরের এক বিলুপ্ত শহর। গ্রিক পুরাণকার তথা ঐতিহাসিকদের মতে, হেরাক্লিয়ন ছিল ভূমধ্যসাগরের পাদদেশে অবস্থিত প্রাচীন মিশরের অন্যতম প্রধান বন্দর-নগরী। নীল নদের বদ্বীপ অঞ্চলে বর্তমান আলেকজান্দ্রিয়া নগরের উত্তরপূর্বে ছিল এই প্রাচীন বন্দর। জলেঘেরা সেই শহরের ঠিক নীচ দিয়েই বয়ে গেছে ভূমধ্যসাগর। সুদূর অতীতে মূলত গ্রিস ও দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে বাণিজ্যিক আদানপ্রদানের জন্য ব্যবহৃত হত এই বন্দর। প্রাচীন মিশরীয়রা এই শহরকে ‘থনিস’ অথবা ‘তাহোনে’ বলে অভিহিত করত। গ্রিক শব্দ তাহোনের অর্থ হল সমুদ্রের প্রবেশদ্বার। সুদূর অতীতে খুবই সমৃদ্ধশালী বন্দর ছিল এই হেরাক্লিয়ন। প্রাচীন মিশরীয়রা বিশ্বাস করতেন হেরাক্লিয়নের সুখ সমৃদ্ধির পেছনে আছে বন্যা ও শস্যফলনের দেবতা হাপির আশীর্বাদ।

মিশর পুরাণমতে, নীলনদের বন্যার দেবতা ছিলেন হাপি। মহা ধুমধাম করে হাপির পূজা করত মিশরীয়রা। তারা বিশ্বাস করত দেবতা হাপি তুষ্ট হলে তবেই প্লাবন আসবে নীলনদের জলে। নতুন পলিতে উর্বর হবে জমি। উর্বরতার দেবতা বলেই হয়তো হাপিকে অনেক পুরাণে ‘দেবতাদের পিতা’ বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। পুরুষালি শরীর এবং নারীর মতো বুকের গঠনের এই দেবতা ছিলেন মিশরীয় দেবতা গেবের বন্ধু আর শস্যের দেবতা নেপারের প্রভু। মনে করা হত আসওয়ানের নিকটবর্তী নীল নদের উৎসের কাছাকাছি একটা গুহায় বাস করেন এই দেবতা।

নীলনদের দুপাশের পলি-গঠিত সমভূমি ছিল চাষবাসের উপযুক্ত। আর তাদের প্রকৃতি নির্ভর কৃষিকাজে বন্যার গূরুত্বও ছিল অপরিসীম। বাণিজ্যনগরী হলেও হেরাক্লিয়নের অধিবাসীদের মূল জীবিকা ছিল চাষাবাদ, ফলে দেবতা হাপি ধীরে ধীরে সেখানকার প্রধান দেবতায় পরিণত হয়। মিশরীর পুরাণের কাহিনি অনুসারে, দেবতা হাপি স্বর্গে যেখানে থাকত, সেখানেই প্রথম প্লাবন আসে। তিনি সেই প্লাবনকে সঙ্গে নিয়ে পৃথিবীতে আসেন এখানকার নির্জীব মরা মাটিকে জীবিত করার জন্য। সে যুগে বন্যা বা প্লাবনের আশা নিয়ে হাপির পুজো দিত মিশরীয়রা। নদীর পাড়ে একত্র হয়ে তারা প্রার্থনা করত। দেবতাকে তুষ্ট করার জন্য নৈবেদ্য হিসাবে নদীর জলে ছুড়ে দেওয়া হত নানা ধরনের শস্য, পশুপাখি। তাঁরা বিশ্বাস করতো ফসল আর জীবজন্তুর ভেট পেয়ে খুশি হবেন বন্যার দেবতা হাপি। বন্যার তোড়ে সাধারণ মানুষের ঘরদোর ভাসিয়ে দেবেন না, বরং পরিমিত প্লাবন দিয়ে ফসল রক্ষা করবেন, সাহায্য করবেন চাষাবাদে।

দেড় হাজার বছর আগে গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাসের বর্ণনায় এই নগরীর কথা প্রথম জানা যায়। তাঁর মতে হেলেনকে নিয়ে স্পার্টা থেকে পালানোর সময়ে ট্রয়ের রাজপুত্র প্যারিস প্রথমে নীল নদের মোহনায় এই হেরাক্লিয়ন বন্দরে আসে। এখানে মিশরের রাজা প্রোতেউস-এর নির্দেশে তাদের আটক করা হয় ও রাজধানী মেমফিসের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করা হয়। হেরোডোটাস ছাড়াও ডায়োডোরাস সহ সমকালীন আরও কয়েকজন ইতিহাসবিদের লেখায় একাধিকবার এই শহরের উল্লেখ পাওয়া যায়। পুরানো অনেক পুঁথিতেও মেলে এই শহরের বর্ণনা। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর কোনও এক সময় সমুদ্রের জলে ডুবে যায় এই শহর, চিরকালের মতো হারিয়ে যায় লোকচক্ষুর আড়ালে। ধারণা করা হয়, এক ভয়ংকর ভূমিকম্পে ভেঙেচুরে ছারখার হয়ে যায় এই শহর, তারপর তাকে গ্রাস করে সমুদ্র। বহু বছর ধরে ভূমধ্যসাগরের তলদেশে চাপা পড়া এই শহরের খোঁজ জানত না কেউ। ধরে নেওয়া হয়েছিল, হারিয়ে যাওয়া শহর এল-ডোরাডো বা আটলান্টিসের মতো হেরাক্লিয়নও হয়তো নিছক এক রূপকথা, বাস্তবে যার কোনও অস্তিত্বই নেই।

১৯৯৮ সালে বিখ্যাত ফরাসি প্রত্নতাত্ত্বিক ফ্র্যাঙ্ক গুডির নেতৃত্বে একদল গবেষক ভূমধ্যসাগরের নীচে ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের একটি যুদ্ধ জাহাজের খোঁজ করছিলেন। মিশরের আবু কি উপসাগর অঞ্চলে খোঁজ চালাতে চালাতে তাঁরা আশ্চর্যভাবে জলের নীচে এক প্রত্ন শহরের নিদর্শন খুঁজে পান। ইতিহাসের এক নতুন দিগন্ত খুলে দেয় এই আবিষ্কার। এরপর ২০০০ সাল নাগাদ ইউরোপিয়ান ইনিস্টিটিউট ফর আন্ডারওয়াটার আর্কিওলজির উদ্যোগে ও মিশরীয় পুরাতত্ত্ব কাউন্সিলের সহায়তায় গঠন করা হয় একটি দল। এই দলটির শিরোভাগেও ছিলেন প্রত্নতাত্ত্বিক ফ্রাঙ্ক গুডি। সমুদ্রতীর থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে জলের তলায় প্রায় ১,২০০ বছরের জমে থাকা পলি ও বালির স্তর সরিয়ে হঠাৎই তিনি আবিষ্কার করেন মিশরীয় দেবতা হাপির মূর্তির ধ্বংসাবশেষ। পাথর কুঁদে তৈরি প্রকাণ্ড এই মূর্তির ওজন ছিল প্রায় ৬ টন।

এরপর টানা ১৩ বছর জলের নীচে খননকাজ চালায় গুডি ও তাঁর দলবল।। একে একে উদ্ধার করেন বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। উদ্ধারকাজের শুরুতে সমুদ্রের তলদেশে কাদাবালির নীচে চাপা পড়ে থাকা বিশাল বিশাল ভাস্কর্যগুলো ক্রেনে বেঁধে তুলে আনা হয় জলের উপরে। এরপর জাহাজে করে নিয়ে যাওয়া হয় সমুদ্রতীরে। এভাবেই একে একে আবিষ্কার হয় দুশোর বেশি বিভিন্ন ধরনের মূর্তি, হায়ারোগ্লিফিক শিলালিপি, ধাতব জিনিসপত্র, মুদ্রা ও ফারাওদের ব্যবহৃত স্বর্ণালঙ্কার। এই প্রত্ন-শহরের বুকে দাঁড়িয়ে গবেষকদের মনে হয়েছিল জলের তলায় ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে যেন এক দুর্লভ রত্নখনি। বলাই বাহুল্য, এই আবিষ্কার সেদিন চমকে দিয়েছিল বিশ্বের তাবড় ইতিহাসবিদকে। বোঝা যাচ্ছিল, ইতিহাসের কোনও এক সমৃদ্ধ বড়ো শহর তলিয়ে গেছে জলের তলায়। ইতিহাস ঘেঁটে পুরাতাত্ত্বিকরা নিশ্চিত হন যে, তলিয়ে যাওয়া এই শহরটিই পুরাণবর্ণিত সেই হারিয়ে যাওয়া বন্দর-নগরী হেরাক্লিয়ন বা থনিস।

ইতিহাসের এক আশ্চর্য শহর হেরাক্লিয়ন। গ্রীক ও মিশরীয় সভ্যতার মিশেল ঘটেছিল এই বন্দরনগরীতে। হোরাডোটাসের মতে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে গ্রিক দেবতা বীর হেরাক্লেস আসেন এই বন্দরে। তার সম্মানেই গ্রিকরা এই শহরের নাম দেয় ‘হেরাক্লিয়ন’। খননকার্য চলাকালীন শুধু প্রাচীন শিলালিপিই নয়, ৬৪টিরও বেশি জাহাজের ধ্বংসাবশেষ ও ৭০০টি নোঙর খুঁজে পাওয়া যায় জলের তলায়। একসঙ্গে এতগুলো জাহাজের ধ্বংসাবশেষ থেকে একটা জিনিস স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছিল, ধ্বংস হয়ে যাওয়া এই শহরে নিশ্চয়ই ছিল কোনও বিখ্যাত সমুদ্র-বন্দর। নিশ্চয়ই প্রতিদিন বহু জাহাজ এসে ভিড়ত এখানে। জলের তলায় প্রচুর স্বর্ণমুদ্রা ও তামা এবং পাথরের বাটখারাও খুঁজে পাওয়া যায়, যা প্রমাণ করে ব্যবসার জন্যও বেশ প্রসিদ্ধ ছিল এই অঞ্চল। সোনার তৈরি অনেক তৈজসপত্রও উদ্ধার করা হয় এখান থেকে।

জলের নীচ থেকে তুলে আনা হয় দু হাজার বছরের পুরনো মিশরীয় দেবী আইসিসের আদলে বানানো তৃতীয় ক্লিওপেট্রার মূর্তি। হাপি ছাড়াও এক ফারাওয়ের মূর্তির সন্ধানও মিলেছিল। মূর্তি ছাড়া আরও পাওয়া গিয়েছিল গ্রিক ও মিশরীয় ভাষায় খোদাই করা পাথরের ফলক ও বেশ কয়েকটি শবাধার। এসব শবাধারের মধ্যে ছিল দেবতা আমুনের উদ্দেশ্যে বলি দেওয়া বিভিন্ন পশুর মমি। এদেরকে উৎসর্গ করা হয়েছিল দেবতাদের রাজা ‘আমুন’-এর উদ্দেশ্যে। এত বছর জলের নীচে থাকার পরেও এই মমিগুলো প্রায় অবিকৃত অবস্থায় ছিল। সাগরের অতল থেকে উঠে আসা এই নিদর্শনগুলো থেকে জানা গিয়েছে প্রাক মিশরীয় ও গ্রিক সভ্যতার সময়কার এযাবত না-জানা বিবিধ তথ্য।