একটি গানের স্কুলের অতিথি হয়ে হাজির হয়েছেন সেকালের হিন্দি ছবির সংগীত পরিচালক হনুমানপ্রসাদ। নীচের তলায় গানের স্কুলের অতিথিকে নিয়ে সবাই যখন ব্যস্ত, সেই সন্ধ্যায় বাড়িটির তিনতলার ভাড়াটিয়া পরিবারের সর্বকনিষ্ঠা সদস্যা হারমোনিয়াম বাজিয়ে গলা সাধছিলেন। তাঁর সুরেলা কণ্ঠ শুনে সংগীত পরিচালক হনুমানপ্রসাদ মেয়েটির সঙ্গে আলাপ করতে চাইলেন। খবর পাঠিয়ে মেয়েটিকে ডেকে আনা হল। মেয়েটির গান শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলেন তিনি।এর কিছুদিন পরেই তাঁর ‘ভক্ত প্রহ্লাদ’ ছবিতে ওই কিশোরীর কণ্ঠ ব্যবহার করলেন।

ফরিদপুরের জমিদার বাড়ির মেয়ে গীতা ৪২-এর ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের জেরে স্বভূমি ছেড়ে মুম্বাই আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। ১৯৪৬ সালে হনুমানপ্রসাদের হাত ধরে সিনেমার গান গেয়ে শুরু করেন সংগীতজীবনের যাত্রা।পরবর্তীতে তিনি জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী গীতা দত্ত। সুরাইয়া পরবর্তী প্লে-ব্যাক সিঙ্গারদের মধ্যে তিনি জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের কণ্ঠস্বর এবং গায়কীর কারণে। তাছাড়া কণ্ঠে এমন মায়া এবং জাদু সচরাচর মেলে না। অনেকটা ধুমকেতুর মতো তিনি হিন্দি ও বাংলা গানের জগতে হাজির হয়েছিলেন, মায়াবী কণ্ঠের জাদুতে শ্রোতাদের বশও করেছিলেন কিন্তু বিদায়বেলা খুব দুঃখজনক পরিস্থিতিতেই কেটেছিল গীতা দত্তর।

‘ভক্ত প্রহ্লাদ’ ছবির একটি গানের কয়েক কলি গাওয়ার সূত্রে এক বছরের মধ্যে তিনি আধ ডজন ছবিতে গান গাইবার সুযোগ পেয়েছিলেন। যদিও সেসব গান-এর কোনওটাই তাঁর হিট গানের তালিকায় ঠাঁই পায় না। কিন্তু স্বয়ং শচীন দেববর্মণও তাঁর কণ্ঠের জাদুতে মজে গিয়েছিলেন। ১৯৪৭-এ মুক্তি পাওয়া ‘দো ভাই’ ছবিতে শচীন দেববর্মণের সুরে ‘সুন্দর সপনা বীত গয়া’ প্রভৃতি গানের জন্য গীতা দত্ত হয়ে গেলেন মুম্বাই সিনেমা দুনিয়ার অন্যতমগায়িকা।লতা মঙ্গেশকরের বিপুল জনপ্রিয়তার আগে পর্যন্ত তিনিই ছিলেন প্লে-ব্যাকের রানি।

১৯৫১-তে ‘বাজি’ ছবিতে সেই শচীন দেববর্মণের সুরে ফের তুমুল হইচই। ‘তদবির সে বিগড়ি হুয়ি তকদির বনালে’, ‘শূন্যে গজর ক্যা গয়ে’, ‘ইয়ে মৌন আয়া কি মেরে দিল কি দুনিয়া মে বাহার আয়ি’। এবার গীতার গানে মুগ্ধ হয়ে প্রেমে পড়লেন গুরু দত্ত। তাঁর ‘আসমান’ ছবিতে প্রধান গায়িকা নির্বাচিত হলেন গীতা। এবার সংগীত পরিচালক ওপিনাইয়ার, যার সুরে গীতা বরাবরই ঝলসে উঠেছেন। কিন্তু গুরু দত্ত-র ‘আসমান’ ফ্লপ করল, হিট করল গীতার গাওয়া ‘দিল হ্যায় দিওয়ানা’, ‘দেখো জাদু ভরে মোরে নেন’। গীতা নতুন করে হাজির হলেন শ্রোতাদের সামনে। অনেকেই ‘আসমান’-এর ব্যর্থতায় গীতা আর গুরু দত্তর সম্পর্কের পরিণতির ভবিষ্যৎ দেখতে শুরু করেছিলেন। পরবর্তী ছবি ‘রাজ’-ও বাণিজ্যিকভাবে ব্যর্থ কিন্তু ও পি নাইয়ারের সুরে গীতার ‘অ্যায় দিন অ্যায় দিওয়ানে’, ‘জরা সামনে আ জরা আঁখ মিলা’ হিট করেছিল। বিপুল জনপ্রিয়তা পেল ‘আর পার’ ছবির গান। লোকের মুখে মুখে ফেরে ‘বাবুজি ধীরে চল না’, ‘আভি ম্যায় জওয়ান’, ‘ইয়ে লো ম্যায় হারি পিয়া’, ‘শুন শুন জালিমা’

ফের হিট গীতা দত্ত। এবারও ও পি নাইয়ারের সুর; ছবির নাম ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস ফিফটি ফাইভ’,এই ছবিতে মহঃ রফির সঙ্গে গীতার ‘জানে কঁহা মেরা জিগর গয়া জি’, ‘উধর তুম হাসিন হো’ এবং একক ‘প্রীতম আন মিলো’, ‘নীলি আসমান’ বিপুল সাড়া ফেললো। একই সঙ্গে আলোড়ন তুললো‘হাওড়া ব্রিজ’ ছবিতে গাওয়া গীতার‘মেরা নাম চিন চিন চু’।

ইতিমধ্যে গীতা আর গুরু দত্তর প্রেম দাম্পত্যে পরিণতি পায়। গুরু দত্ত তখনও নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার লড়াই চালাচ্ছেন। ততদিনে গীতা কেবল প্রতিষ্ঠিতই নয়, প্লে-ব্যাক সিঙ্গার হিসেবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে পড়েছেন। কিন্তু খুব বেশি দিন যেতে না যেতেই সেই দাম্পত্য জীবনের পথ অন্যদিকে বাঁক নেয়। জীবনযাত্রা হয়ে ওঠে জটিল।এরপরেই গুরু দত্ত-র ফরমান—তাঁর ছবি ছাড়া গীতা অন্য কোথাও গান গাইতে পারবেন না। তিন সন্তানের মা গীতাকে ততদিনে মায়ের ভূমিকায় সক্রিয় হয়ে উঠতে হয়। অন্য দিকে গুরু দত্ত-র ছবি বাণিজ্যিক সফলতা পেতে শুরু করেছে। তবে গীতা তখন মনেপ্রাণে একা, অসহায় বোধ করতে শুরু করেছেন।

এই অসহায়তা গীতা মেনে নিতে পারেননি। তাই স্বামীকে না জানিয়ে ফের রেকর্ডিং স্টুডিওতে যাতায়াত শুরু করেন। রিহার্সাল, রেকর্ডিং সবই স্বামী বাড়ি ফেরার আগে।এইভাবে চোর-পুলিশ খেলার ফাঁকে কিছু গান হিট করে গেলেও গীতার সময় নিয়ে বাধ্যবাধকতা সংগীত পরিচালকরা ঠিক মেনে নিতে পারলেন না। ফেরার তাড়ায় গীতার গানে মন থাকে না, কাজও সম্পূর্ণ হয় না। শচীন দেববর্মণ, ও পি নাইয়ারের প্রিয় শিল্পীর জায়গা এভাবে একদিন দখল করে নেন লতা মঙ্গেশকর ও আশা ভোঁসলে। অন্যদিকে স্বামীকে না জানিয়ে গীতার গান গাওয়া—শেষ পর্যন্ত অন্য বাঁকে মোড় নেয়। বেগতিক বুঝে গুরু দত্ত গীতাকে নায়িকা করে ‘গৌরী’ ছবির কাজ শুরু করেন।

গীতা ফের স্বপ্নের ডানায় ভর করে উড়তে থাকেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন ভেঙে যায় স্টুডিওতে স্বামীর নায়িকা-প্রেমিকা আবিষ্কার হলে। গীতা আশ্রয় নেন অ্যালকোহলে। ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়া প্লে-ব্যাক তারকার জীবনে নেমে আসে আর্থিক সংকট। গুরু দত্ত ততদিনে বেছে নিয়েছেন আত্মহননের পথ। গীতা একটা কাজের জন্যসংগীত পরিচালকদের দরজায় দরজায় ঘুরেছেন। স্টেজে গান গাইবার জন্য অনুনয় বিনয় করেছেন। ততদিনে স্মৃতি হয়ে যায় ‘সিআইডি’-র ‘আঁখো হি আঁখো মে ইশারা’, ‘শর্ত’-এর ‘না ইয়ে চাঁদ হোগা’, ‘মুনিমজি’-র ‘দিল কি উমঙ্গ হ্যায় জওয়ান’, ‘পিয়াসা’ ছবির ‘জানে কা তুনে কহি’, ‘ওয়াক্ত নে কিয়া হসিন সিতম’- ‘কাগজকে ফুল’, ‘বচপন কে দিন ভি ক্যা দিন থে’- ‘সুজাতা’, ‘বালম মে মিলন হোগা’- ‘চৌধবি কা চাঁদ’-, ‘নিশিরাত বাঁকা চাঁদ আকাশে’- ‘পৃথিবী আমারে চায়’, ‘তুমি যে আমার’- ‘হারানো সুর’, ‘এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়’- ‘হসপিটাল’, সাথীহারা ছবির ‘বাঁশি বুঝি সেই সুরে’ প্রভৃতি কালজয়ী গান। রোজগারের আশায় ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত, অবসন্ন কিন্নরকণ্ঠীর প্রাণস্পন্দন স্তব্ধ হয়ে যায় মাত্র চৌত্রিশ বছর বয়সে।

Share.

1 Comment

  1. dilip kumar sen on

    প্রকৃত শিল্পীর জীবনধারা কোনও ছকের পথে চলে না, তাদের আবির্ভাব ধূমকেতুর মতো কিন্তু মিলিয়ে যাওয়ার পরও রেশ থেকেই যায়।

Leave A Reply

Exit mobile version