নির্বাক ও সবাক বাংলা সিনেমার ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় সমধিক পরিচিত ‘ডিজি’বহু পরিশ্রমে ১৯২৭ সালে 'শঙ্করাচার্য্য' ছবিটি তৈরির পর প্রযোজক সংস্থা 'কিনেমা আর্টস'-এর সঙ্গে ঝামেলা বাধে। কোম্পানি ডিজি-কে বরখাস্ত করার পাশাপাশি ছবিটির টাইটেল কার্ড থেকে তাঁর নামও মুছে দেয়। দারুণ অপমানিত ডিজি এরপর বহু কষ্টে নিজেই তৈরি করেন 'দ্য ব্রিটিশ ডোমিনিয়ন ফিল্ম কোম্পানি'।
ব্রিটিশ ডোমিনিয়ন ফিল্ম কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করে টাকা জোগার করে ডিজি ফের ছবি বানানোর তোড়জোড় শুরু করলেন। ইতিমধ্যে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় শক্তিগড়ের এক যুবকের। কলেজ পড়ুয়া যুবকটি গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনেও সামিল, ভাল গল্প লেখে পাশাপাশি শক্তিগড়ের ‘শক্তি’ নামের একটি ছোট্ট পত্রিকার সম্পাদক। সিনেমায় তাঁর দারুণ আগ্রহ। যুবকটিকে ডিজি-র খুব পছন্দ, ডিজি তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে এলেন কলকাতায়।
শুরু হল ডিজি-র ‘দ্য ব্রিটিশ ডোমিনিয়ন ফিল্ম কোম্পানি’-র প্রথম ছবি।পরিচালক ‘কল্লোল’ পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক দীনেশরঞ্জন দাশ। ছবির গল্প ও চিত্রনাট্য লেখানো হল সেই যুবককে দিয়ে। কেবলগল্প ও চিত্রনাট্য লিখে সুদর্শন চেহারার যুবকটি রেহাই পেলেন না, তাঁকে ডিজি ছবির নায়ক ‘দেববর্মণ‘-এর চরিত্রে অভিনয়ও করালেন।

ডিজি-র ‘কামনার আগুন’ যেমন রমরম করে চললো তেমনি ছবির গল্প, চিত্রনাট্য রচয়িতা ও নায়করূপে রুপোলি পর্দায় আত্মপ্রকাশ করে সেই যুবকও প্রশংসিত হলেন। ডিজি-র পরের ছবিতেসেই যুবক অভিনয় করলেন না, নিজের চিত্রনাট্যে পরিচালনা করলেন ‘পঞ্চশর’।বাংলাসিনেমা জগত পেল এক অন্য প্রতিভা ও দারুণ সম্ভাবনাময় উত্তরসূরির।সেই যুবক দেবকীকুমার বসু ছিলেন ডিজি-রআবিস্কার।
‘অপরাধী’, ‘চণ্ডীদাস’, ‘পুরাণ ভকত’, ‘মীরাবাঈ’, ‘সীতা’, ‘বিদ্যাপতি’, ‘সাপুড়ে’, ‘কবি’, ‘রত্নদীপ’, ‘চিরকুমার সভা’, ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য’, ‘অর্ঘ্য’ প্রভৃতি বাংলা-হিন্দি কালজয়ী ছবিতে স্বাক্ষরিত হয়েছে তাঁর অসামান্য প্রতিভা। ভারতীয় সিনেমায় প্রথম ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বা আবহসঙ্গীতের ব্যবহার তাঁর পরিচালিত ছবি ‘চণ্ডীদাস’ (১৯৩২)-এ। ১৯৩৫ সালে ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘সার্টিফিকেট অব মেরিট’ পায় তাঁর ‘সীতা’। ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে প্রথমবার বিদেশি সম্মান। তাছাড়া, ছবিতে থিয়েটারধর্মী অভিনয়ের পরিবর্তে বাস্তবধর্মী অভিনয় রীতির শুরুও তাঁরই হাতে, তাঁরই ছবিতে।

দেবকী বসুর ‘চণ্ডীদাস’ প্রথম সার্থক বাংলা সবাক চলচ্চিত্র। এই কথা বলা সিনেমাটি দেখে বাঙালি চমকে গিয়েছিল,মুগ্ধ হয়েছিল। ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে ‘চণ্ডীদাস’ প্রথম সিলভার জুবিলি হয়েছিল। ‘চণ্ডীদাস’-এ বাঙালি প্রথম সিনেমায় শুনতে পেল সংলাপ, গান ওআবহ সঙ্গীত।এতকাল সিনেমায় জায়গা পেত হিন্দু উচ্চবর্ণ সমাজের ধর্ম ভাবনা ও প্রেম। দেবকী বসু প্রথম সাহসী পদক্ষেপে করলেনঅন্ত্যজ জনের প্রেম বিরহের দুনিয়ায়। চৈতন্যদেবের হাত ধরে ভক্তি আন্দোলনের যে ভাবধারা বাংলার মাটিতে পৌঁছেছিলসেই স্রোতের সঙ্গে বাংলা সিনেমার দর্শকদের জুড়ে দিয়ে তিনি যেটা ঘটিয়েছিলেন তাকে ইতিহাস বলা যায়। কারণ সেদিনের বাঙালি দর্শক কিন্তু বাস্তবিকই উচ্চবর্ণের চণ্ডীদাসের সঙ্গে নিম্নবর্ণের ধোপানি রামির প্রেমকথায় ভেসে গিয়েছিল। তারা বাংলা সিনেমা হলে বসেও বর্ণাশ্রম বিরোধী সেই অমর বাণী, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’ শুনেছিল।
সিনেমার ম্যাজিক ল্যান্টার্নের যুগে অর্থাৎ নির্বাক পর্বেরও আগে সাহেবদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে কালো পর্দায় লণ্ঠন জ্বালিয়ে ছবির প্রতিফলন দেখাতেন। ছেলেবেলায় তার মুখস্থ বলে যাওয়া ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ শুনতে গ্রামের মানুষ বৈঠকখানায় ভিড় জমাতো। আইএ পরীক্ষায় ইতিহাস ও ইংরেজিতে লেটার নম্বর পাওয়া ছাত্র শিশির ভাদুড়ীর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর তাঁর পরিচালনায় ১৯১৯-এ ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে ‘সোহরাব রুস্তম’ নাটকে সেনানায়কের ভূমিকায়, ‘মেবার পতন’ নাটকে মহব্বৎ খাঁয়ের চরিত্রে অভিনয় করে প্রশংসা পান। এরপর গাঁধীর অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ায় বিএ পরীক্ষা দেওয়া হয় না। ইংরেজ শাসক ও শাসনের বিরুদ্ধে লেখার জন্য রাজরোষেও পড়েছিলেন।
সীতা’-র জন্য ১৯৩৪ সালে দ্বিতীয় ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে ‘অনারারি ডিপ্লোমা’ পুরস্কার ছাড়াও ছবিটি ‘মুসোলিনি কাপ’ পুরস্কারের জন্যও মনোনীত হয়েছিল। সেখানে ছিল রবার্ট ফ্ল্যাহার্টির ‘ম্যান অফ অ্যারঁন’, ফ্র্যাঙ্ক কাপরার ‘ইট হ্যাপেন্ড ওয়ান নাইট’, জর্জ কিউকারের ‘লিটল উয়োম্যান’ ও জেমস হোয়েলের ‘ইনভিজ়িবল ম্যান’-এর মতো ছবি। দেবকী বসু ১৯৫৯ সালেও নবম বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ফের হাজির হয়েছিলেন তাঁর ‘সাগর সঙ্গমে’ ছবিটি নিয়ে। এই ছবিটিও সে বছর ‘স্বর্ণভল্লুক’ বা গোল্ডেন বেয়ার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়। প্রতিযোগিতায় ছিল আকিরা কুরোসাওয়ার ‘দ্য হিডেন ফোর্ট্রেস’ ও সিডনি ল্যুমটের ‘দ্যাট কাইন্ড অফ উয়োম্যান’। বাংলা সিনেমা দুনিয়ায় দেবকী বসু রাজ করেছেন গত শতকের তিরিশের দশক থেকে পঞ্চাশের দশক। প্রতি ছবিতে তিনি পারিশ্রমিক নিতেন আড়াই লক্ষ টাকা, যা সেই সময় ছিল কল্পনার অতীত।
1 Comment
কেবল সিনেমা নয়, সিনেমার ভিতরে বাইরেও এমন অনেক কিছু আছে যা ইতিহাস রচনা করে। দেবকি বসু সেই বিরল সিনেমা ব্যক্তিত্বের একজন।