শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। সংবাদসংস্থা সূত্রের খবর, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দিল্লি এইমসে ভর্তি করা হয়েছিল ৯২ বছরের মনমোহনকে। সূত্রের খবর, তিনি শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন। তাঁকে আইসিইউতে রাখা হয়েছিল। এইমসের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, বার্ধ্যক্যজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী। সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ বাড়িতে অচৈতন্য হয়ে পড়েন তিনি। রাত রাত ৮টা ৬ মিনিটে তাঁকে এইমস হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। তারপর অনেক চেষ্টা করেও চিকিৎসকরা তাঁকে বাঁচাতে পারেননি। রাত ৯ টা ৫১ মিনিটে তাঁর জীবনাবসান হয়।

২০০৪ সালে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউপিএ সরকারে প্রধানমন্ত্রী হন মনমোহন সিং। ২০০৪ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী পদে ছিলেন তিনি। এর আগে পিভি নরসিংহ রাওয়ের মন্ত্রীসভায় অর্থমন্ত্রী ছিলেন মনমোহন। ১৯৯১ সাল থেকে রাজ্যসভার সদস্য তিনি। ১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত রাজ্যসভায় বিরোধী দলনেতাও ছিলেন তিনি। ১৯৮২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৮৫ সালের ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর পদেও আসীন ছিলেন মনমোহন সিং। ৩৩ বছর পর চলতি বছরের এপ্রিলে অবসর নেন।

মূলত অর্থনীতির জগতের লোক হিসেবেই পরিচিত মনমোহন। এক দশক দেশের প্রধানমন্ত্রী থাকার পাশাপাশি অর্থমন্ত্রী হিসেবেও তাঁর অবদান যথেষ্টই গুরুত্বপূর্ণ। নরসিংহ রাও সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে দেশে বাজার অর্থনীতি চালু করার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা ছিল মনমোহনের। ১৯৩২ সালে পশ্চিম পাঞ্জাবের গাহ-তে (বর্তমানে পাকিস্তানে) পাঞ্জাবি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন মনমোহন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর আসেন এপারে। বরাবরই লেখাপড়ায় তুখোর ছিলেন মনমোহন। স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্য়ালয় থেকে প্রথম হয়েছিলেন। এরপর অর্থনীতিতে ডক্টরেট করেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এরপর শুরু তাঁর আমলা জীবন। প্রথমে রাষ্ট্রসংঘে ভারতের হয়ে দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। পরে ৭০য়ের দশকে ভারত সরকারের বহু গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন তিনি। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, প্রধান আর্থিক উপদেষ্টা (১৯৭২-৭৬), আরবিআইয়ের গভর্নর (১৯৮২-৮৫), পরিকল্পনা কমিশনের চেয়ারম্যান (১৯৮৫-৮৭)।

৯০-এর দশকের একেবারে শুরু। সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে টুকরো টুকরো হয়েছে। ভারতও আর্থিক কষ্টে ডুবছে। এই অবস্থায় দেশের হাল ধরতে প্রদানমন্ত্রী নরসিমা রাও অর্থমন্ত্রকের দায়িত্ব তুলে দেন শিক্ষাবিদ ডঃ মনমোহন সিংয়ের হাতে। তাঁর হাত ধরেই দেশের অর্থনীতিতে এল উদারীকরণ। বিশ্বের দ্বার খুলে গেল ভারতীয়দের সামনে। বলা যায় এ এক নয়া আর্থিক বিপ্লব। যার জনক ডঃ মনমোহন সিং।এরপর ভারতীয় রানীতিতে বহু টানাপোড়েন চলেছে। জন্ম নিয়েছে জোট সরকার। এনডিএ সরকারের পতনের পর ১৯৯৯ সালে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সনিয়া গান্ধী বেছে নেন কংগ্রেসের প্রতি চির আস্থাশীল মনমোহন সিংকে। এই সরকার পাঁত বছর অতিক্রম করে। ফের ২০০৯ সালে ইউপিএ জোট জিতে ক্ষমতায় ফিরলে ডঃ মনমোহনকেই দেশের প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসান সনিয়া। তবে, সমালোচনা হয় মনমোহনের। সনিয়া-রাহুলের ‘কাঠপুতুল’ বলে কটাক্ষে বিদ্ধ হন এই শিক্ষাবদ।

২০১৪ সালে ধরাশায়ী হয় মনমোহন সরকার। কিন্তু রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন তিনি। শেষে চলতি বছর সাংসদ পদের মেয়াদ শেষ হতে সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নেন তিনি। তবে, শেষদিন পর্যন্ত হাত ছাড়েননি তিনি। সাংসদ হিসাবে শেষ ভাষণে নরেন্দ্র মোদী সরকারের নোট বাতিলের নিন্দা করেছিলেন। ওই পদক্ষেপকে “সংগঠিত লুট এবং বৈধ লুণ্ঠন” বলে তোপ দেগেছিলেন। পূর্বসূরী সম্পর্কে অবশ্য শেষে সৌজন্যের প্রশংসা শোনা গিয়েছিল প্রধানমন্ত্রী মোদির মুখে। মনমোহনের কাজের একাগ্রতা, নিষ্ঠার স্তুতি করেছিলেন মোদি। কিন্তু, প্রধানমন্ত্রী হয়ে সরকারের বহু অনৈতিক কাজে রুখে দাঁড়াতে না পারায় বারে বারে সমালোচিত হন প্রশাসক মনমোহন। তবে দেশ তাঁকে মনে রাখবে উদার অর্থনীতির জনক হিসাবে দেশের অর্থনীতিতে বিশাল অবদানের জন্য।
