অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরা প্রদেশ থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে ৪০ কিলোমিটার দূরে জর্জ লেক। লেক হলেও এই লেক ম্যাজিকের মতো কিংবা রূপকথার মতো। কারণ, আপাতত হ্রদ বলে পরিচিত হলেও বছর দশেক আগেও পুরো জায়গাটা ছিল বিরাট এক মাঠের মতো। জে মাঠ ভরে থাকত বড়ো বড়ো ঘাসে। এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াতো তৃণভোজী পশুরা। ১৫৫ বর্গ কিলোমিটার জুড়েই তখন এই রকম দৃশ্যই চোখে পড়ত। ম্যাজিক বা রূপকথার রাজ্য বলা হলেও আসলে তো একটা গোটা হ্রদ। কিন্তু তার জল আচমকাই উধাও হয়ে যায়। আবার কয়েক বছরের মধ্যে জলে ভরে যায়। কিন্তু এমনটা হয় কিভাবে তা নিয়েই রহস্য।

এই লেক পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো হ্রদগুলির মধ্যে অন্যতম। এই হ্রদের জন্ম কয়েক হাজার বছর আগে বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু গোটা হ্রদটাই যেন অস্থির। কিছুতেই তার অবস্থান একজায়গায় নয়। উনিশ শতকের শুরুতে প্রথমবার এই হ্রদের অদ্ভুত কাণ্ড নজরে আসে মানুষের চোখে। একবার নয় একাধিকবার ঘটেছে এই ঘটনা। আসলে মাঝে মাঝেই এই হ্রদের জল পুরো অদৃশ্য হয়ে যায়। গরমের দিনে খালে-বিলে-নদীতে জল শুকিয়ে যাওয়ার ঘটনা আকছার ঘটে। কিন্তু এই লেকের জল একটু একটু করে শুকোয় না। হঠাৎ করে একদিন উবে যায়। যেভাবে ১৮৪০ সাল নাগাদ একদিন লেকের জল হটাৎ একদিন উধাও হয়ে গিয়েছিল। বিশ শতকেও একই ঘটনা দেখা যায়। ১৯৮৬ সালে জলশূন্য হয়ে গেলেও, ১৯৯৬-তে আবার জলে ভরে যায় গোটা হ্রদ। ২০০২ এবং ২০১৬ সালেও ঘটেছে ঠিক একই ঘটনা।

লেকের জল উধাও হয়ে যায় এই ঘটনার কথা জানাজানি হতে ১৯৭১ সালে অস্ট্রেলিয়ার ভূতত্ত্ববিদ প্যাট্রিক ডে লেক পর্যবেক্ষণ শুরু করেছিলেন। তাঁর গবেষণা থেকে জানা যায়, আসলে এই লেক এলাকা একটি অবনত ভূমি। বিশেষ গভীরও নয়। তার তলায় জল থাকে। বৃষ্টির জল জমে জমে উপরে উঠে এলে তখন লেকে জল আছে বলে মনে হয়। আবার এই অঞ্চলে মাঝে মাঝেই তুমুল ঝড় ওঠে। তার জন্য এক প্রান্তের জল অন্য প্রান্তে সরে যেতে পারে বলেও মনে করা হয়। অর্থাৎ, ঠিক কী কারণে মাঝে মাঝেই এই লেকের সব জল উধাও হয়ে যায়, তার সঠিক ব্যাখ্যা মেলেনি এখনও। প্রকৃতির অনেক আশ্চর্যের একটি হয়েই রয়ে গিয়েছে অস্ট্রেলিয়ার জর্জ লেক।

কয়েক হাজার বছর আগে জন্ম হলেও প্রথমে কিন্তু এর কোনো অস্তিত্বই ছিল না। তখন ইয়াস নদী বয়ে যেত দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী পাদদেশ ধরে। তারপর একের পর এক ভূতাত্ত্বিক বিপর্যয়ে সম্পূর্ণ বদলে যায় পরিবেশ। মাঝখানে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেয় জর্জ লেক। এর জল লবণাক্ত। প্রশ্ন কেন এমন ঘটনা ঘটে জর্জ লেকে? স্বাভাবিকভাবেই গজিয়ে উঠেছে অনেক রহস্য কাহিনি। তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় গল্পটি হচ্ছে ক্যানবেরার এই হ্রদের জল কমে গেলে নিউজিল্যান্ডের কোনো এক হ্রদ ফুলে ফেঁপে ওঠে। অবশ্যই কোনো প্রমাণ নেই এই ঘটনার।

প্রসঙ্গত, বেঙ্গালুরু আরবান জেলার ৮৩৭টি লেকের মধ্যে, ১,৩০৭ একর এলাকা জুড়ে ৮৮টি লেক বছরের পর বছর ধরে মানচিত্র থেকে সম্পূর্ণভাবে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে।১৯৮৫ সালে বেঙ্গালুরু এবং এর আশেপাশে ৫১টি লেক ছিল, তবে সংখ্যাটি কমে মাত্র ১৭তে দাঁড়িয়েছে৷ এর ফলে গত চার দশকে শহরটির ইকো-সিস্টেমের একটি ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।

উল্লেখ্য, অ্যান্টার্কটিকা থেকে ১১ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে থাকা সুবিশাল একটি লেক উধাও হয়ে গিয়েছে এক সপ্তাহ বা তারও কম সময়ে। সেই লেকের জলের পরিমাণ ছিল ৬০ থেকে ৭৫ কোটি ঘন মিটার। সেই জল গিয়ে মিশেছে অ্যান্টার্কটিকা মহাসাগরে। গবেষকরা জানিয়েছেন, সেই বিশাল লেকটি ছিল পূর্ব অ্যান্টার্কটিকার অ্যামেরি আইস শেল্ফে। লেকটিতে এতটাই জল ছিল যে তার চাপে লেকের নীচে থাকা পুরু বরফের চাঙড় ফেটে গিয়েছে। আর তারই ফাঁক গলে গোটা লেকের জল বেরিয়ে গিয়ে অ্যান্টার্কটিকা মহাসাগরে মিশেছে। এই ধরনের ঘটনাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় ‘হাইড্রোফ্র্যাকচার’।
