এক নজরে

একা হাতেই পাথর খুঁড়ে জল এনেছিলেন

By admin

July 01, 2023

পাহাড় থেকে নেমে আসা খাল আর ঝরনাগুলো শুকিয়ে প্রায় কাঠ। এক ফোঁটা জলের চিহ্ন কোথাও নেই। পানীয় জল পেতে হলে কয়েক কিলোমিটার পাহাড়ি পথ পেরতে হয়। সেই জলও খুব তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়। সারারাত ধরে কুয়োয় জল জমা হয়, সেই জল সক্কাল সক্কাল যে আগে যায় সেই নিয়ে ঘরে ফিরতে পারে। আর বাকিরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করে একটু জলের জন্য। এটাই এখানকার প্রতিদিনের জল-ছবি। একটি বা দুটি গ্রাম নয় কর্ণাটকে এমন গ্রামের সংখ্যা বহু যেখানে পানীয় জলের জন্য মানুষকে বহু পথ পেরতে হয়, তারপর যে জল মিলবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই, জল যদি বা মেলে তা যে সুপেয় হবে সে কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না।

আসলে বয়স নয়, মানুষের জন্য কিছু একটা করার তীব্র ইচ্ছে। নিজের গ্রাম সহ আশপাশের গ্রামগুলিতে  তীব্র জলাভাব, জলের আশায় গ্রামের মানুষকে যেতে হচ্ছে কয়েক ক্রোশ পাহাড়ি পথ, তারপরও মিলছে না সুপেয় জল তখন অস্থির মন আর স্থির থাকতে পারে না। পাশের কেউ হাত বাড়িয়ে না দিলেও একাই চলতে হয়।

কর্নাটকের দাসানদোড্ডি গ্রামের কামিগুয়াদার এই একা চলার শুরু কিন্তু আজ থেকে প্রায় ৪৮/৪৯ বছর আগে। তখন যুবক কামিগুয়াদা রোজই তাঁর গ্রাম ছাড়িয়ে পাহাড়ে যেতেন ভেড়ার পাল নিয়ে। সারাদিন ভেড়াগুলি পাহাড়ে চরে বেড়াত আর কামিগুয়াদা পাহাড়ের এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে নানা কিছু লক্ষ্য করতেন। একদিন তাঁর মনে হয় গোটা পাহাড়ে কোনো জীবজন্তুর আনাগোনা নেই। কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে তিনি বুঝতে পারেন আশেপাশে ১০/১২ মাইলের মধ্যে কোনও জলাধার নেই। আর সে কারণেই গোটা পাহাড়টাই একেবারে প্রাণী শূন্য। তাছাড়া তিনি যে ভেড়ার পাল নিয়ে পাহাড়ে যান সেখানেও তো জলের দরকার হতে পারে।

এরপরই কিছু একটা করার চিন্তা তার মাথায় আসে। সেই চিন্তা থেকেই একদিন সাত-পাঁচ না ভেবেই গাছের ডাল দিয়েই গর্ত খোঁড়া শুরু করেন। কিছুদিন এভাবেই গাছের ডাল দিয়ে খুড়তে খুড়তে সেটা কয়েক ফুট গভীর গর্ত হয়ে ওঠে। আরও অবাক করার বিষয় হলো একদিন হঠাৎ সেই গর্ত থেকে জল বের হতে শুরু করে। কামিগুয়াদার উত্সাহ দ্বিগুণ বেড়ে যায়। এরপর তিনি একটি কোদাল দিয়ে গর্তটি আরও গভীর করা শুরু করেন। সেই থেকে শুরু। এরপর কত শীত-বসন্ত-শরৎ-হেমন্ত পেরিয়ে গিয়েছে। কামিগুয়াদার জীবন থেকে একে একে বিদায় নিয়েছে যৌবন, বার্ধক্য পেরিয়ে এখন তিনি জীবনের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। কিন্তু সেদিন একার হাতে যে কাজ তিনি শুরু করেছিলেন সেই দায় থেকে একটুও সরে আসেননি।

 ১৯৭০ সালে একটি গাছের ডাল দিয়ে যে ছোট্ট গর্ত খোড়ার উদ্যোগ তিনি  নিয়েছিলেন ২০১৭ সালে তা থেকেই তিনি ৬টি পুকুর খনন করেন। নিজের এই মহৎ কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১৭ সালে রাজ্য সরকারের পুরস্কার লাভ করেন। পুরস্কার হিসেবে পাওয়া নগদ অর্থ তিনি নিজের বা পরিবারের কাজে ব্যয় না করে তা দিয়ে আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে আরো ৮টি পুকুর খনন করেছেন। এছাড়া গ্রাম থেকে পাহাড়ে যাওয়ার জন্য একটি রাস্তাও তৈরি করেছেন। মোট ১৪ টি পুকুর খুঁড়েছেন একার উদ্যোগে। অশীতিপর এই মানুষটি আজ গোটা কর্ণাটক রাজ্যের নায়ক। কর্নাটকের মানুষের কাছে তিনি শান্তি দাদা হিসেবেই পরিচিত। আর তাকে চেনেন না এমন মানুষ খুঁজে সে রাজ্যে খুঁজে পাওয়াও দুস্কর!

দাসানদোড্ডি গ্রামের একটি ছোট্ট ঘরে ছিল কামিগুয়াদার বসবাস। বয়সের ভারে নুয়ে পড়লেও মনের দিক থেকে যে তিনি ছিলেন তরুণ। দিনের প্রায় ১২ ঘণ্টা কাজ করতেন। ৫০টি ভেড়াকে দেখভাল করাই ছিল তাঁর রুটি-রুজির একমাত্র পথ। আর এই কাজের ফাঁকেই তিনি কখনো গাছের চারা রোপণ করতেন, মাটি খুঁড়ে পুকুর তৈরি করতেন। জীবনযাপন করতেন অত্যন্ত দীনহীনভাবে। একটি ছোট্ট কুঁড়ে ঘরে স্ত্রী, দুই সন্তান ও পরিবার নিয়ে ছিল তাঁর বাস। এভাবেই মানুষ আর প্রকৃতির সেবা করে জীবনটা কাটিয়ে দিয়েছেন কামিগুয়াদা।