এক নজরে

দেশ-কালের গণ্ডি ছাড়িয়ে নিষ্ঠাভরে পুজোতেই শক্তির দেবী বিশ্বজনীন

By admin

November 14, 2020

অসৎ থেকে সত্যে নিয়ে যাও, অন্ধকার থেকে আলোয়, আর মৃত্যু থেকে অমরত্বে। উপনিষদের এই কথাই যেন দীপাবলির মূল কথা। দীপাবলি সারা ভারতে আলোর উৎসব। শুধু ভারতবর্ষ নয়, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার সহ বিশ্বের কয়েকটি দেশে এই উৎসব পালিত হয়। দুর্গাপুজোয় যেমন নিষ্ঠার সঙ্গেই একদিকে উৎসব ও অন্যদিকে আড়ম্বরের মেতে ওঠে বাঙালি, এখন পর্যন্ত কালী পুজোয় কিন্তু বেশিরভাগ প্রাধান্যই নিষ্ঠাভরে পুজোর প্রতি। বিদেশে থেকে যেসব বাংলার মানুষ দুর্গাপুজো করেন, তাদের কাছে এটা একটা বাঙালির ঐতিহ্য প্রকাশেরও মাধ্যম। কিন্তু ভিন দেশে থাকা বাঙালির কালীপুজোয় বেশির ভাগটাই জায়গা করে নেয় ভক্তিভরে, নিয়মনিষ্ঠা মেনে পুজোর আয়োজন। সেখানে জাঁকজমক বা আরম্ভর তুলনায় কম থাকে।

দীপাবলি উৎসব শুরু হয় কার্ত্তিক মাসের কৃষ্ণ ত্রয়োদশীতে এবং শেষ হয় শুক্লা দ্বিতীয়াতে। কৃষ্ণ ত্রয়োদশীতে ধনতেরাস বা ধন ত্রয়োদশী। লোকের বিশ্বাস এদিন দামী ধাতু কিনলে ধনের দেবী লক্ষ্মী তাঁর আকর্ষণে গৃহে প্রবেশ করবেন এবং তাদের মনোবাঞ্ছা পূরণ হবে। পশ্চিমবঙ্গে আগে ধনতেরাস এত জনপ্রিয় ছিল না। এখন হিন্দি বলয়ের আগ্রাসনে ধনতেরাসের দিন প্রতিটি সোনার দোকান তো বটেই, এমনকি কাঁসা পেতল ইত্যাদির দোকানেও লাইন পড়ে যায়।

দুটি উপকথা আছে ধনতেরাস নিয়ে। একটি হল, রাজা হিমের ছেলের এক অভিশাপ ছিল। বিবাহের চারদিনের মাথায় সাপের কামড়ে তার মৃত্যু হবে। ১৬ বছর বয়সে রাজা ছেলের বিবাহ দেন এবং পুত্রবধূকে সে কথা জানানো হয়। পুত্রবধূ চারদিনের দিন সমস্ত অলংকার, মুদ্রা জড়ো করে শয়নকক্ষের বাইরে রেখে দেয়। ঘরে সারারাত আলো জ্বেলে স্বামীর সাথে গল্প করতে থাকে। যমরাজ দুয়ারের সামনে এলে গহনা আর আলোর জৌলুসে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। তিনিও সোনার ওপর বসে গল্প শুনতে শুরু করে দেন। এভাবে রাত কেটে যায় এবং রাজপুত্রেরও ফাঁড়া কেটে যায়। দ্বিতীয় কাহিনী হল লক্ষ্মীদেবী দুর্বাসা মুনির অভিশাপে স্বর্গচ্যুত হন এবং অসুরদের হাতে বন্দী হন। দেবতারা যুদ্ধ করে এদিন লক্ষ্মীকে পুনরায় লাভ করেন।

দীপাবলি উৎসবের দ্বিতীয় দিন হল ভূত চতুর্দশী। হিন্দুদের বিশ্বাস এদিন মৃত পূর্বপুরুষেরা মর্তে নেমে আসেন। তাদের উদ্দেশ্যে ঘরের চারদিকে চৌদ্দ প্রদীপ জ্বালানো হয়। যেমনটা খ্রিষ্টানরা ২ নভেম্বর পালন করেন ‘অল সোলস্‌ ডে’। কবরস্থানে আত্মীয়পরিজনরা সন্ধ্যায় মোমবাতি জ্বালায়, ফুল দিয়ে সাজায়। যেমন সবে- বরাতের সন্ধ্যায় কবরস্থানে প্রার্থনার সময় মুসলিম ধর্মের কিছু লোক বাতি জ্বালান।

কালীপূজার আগের দিন চৌদ্দ শাক খাওয়া হয় আচারবশত। চৌদ্দ শাক হল – ওল, কেঁউ, বেতো, সর্ষে, কালকাসুন্দে, নিম, জয়ন্তী, শাঞ্চে, হিঞ্চে, পলতা (পটল লতা), শুলফা, গুলঞ্চ, ভাঁটপাতা (ঘেঁটু) এবং শুষনি। মৃত্যুর পর মানুষ পঞ্চভূতে বিলীন হয়। ‘পঞ্চভূত’ অর্থাৎ আকাশ, মাটি, জল, বায়ু এবং অগ্নি। অর্থাৎ প্রকৃতি। তাই প্রকৃতির কোল থেকে তুলে আনা চৌদ্দ শাক পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা। ভূত চতুর্দশী নিয়ে পুরাণে যে গল্পের অনুমোদন আমরা পাই তা হল, দানবরাজ বলীর কাছে বামনবেশী বিষ্ণু তিন পা রাখার জমি চাইলে দানবরাজ বলী স্বর্গ, মর্ত দান করার পর তৃতীয় পা রাখার জন্য নিজের মস্তক এগিয়ে দেন। তৃতীয় পা বিষ্ণুর নাভি থেকে বেরিয়ে বলীর মাথার উপর রাখলে বলী পাতালে প্রবেশ করে এবং সেখানেই হয় তার আবাসস্থল। তবে বিষ্ণু সন্তুষ্ট হয়ে পৃথিবীতে একদিন তার পূজা হবে বলে আশীর্বাদ করেন। সেই মতো এই দিন রাজা বলী শত সহস্র ভূত প্রেত সহচর নিয়ে মর্তে উঠে আসেন পূজা নিতে।

তৃতীয় দিন হল দীপান্বিতা কালীপূজা। তবে এই কালীপূজা হয় কেবলমাত্র পূর্ব ভারতে অর্থাৎ বাংলা, অসম, ওড়িশা ও বিহারের মিথিলায়। বাকি ভারতবর্ষে হয় লক্ষ্মী – গণেশ পূজা। উত্তর ভারতে রঙিন গুঁড়ো দিয়ে রঙ্গোলী আলপনা দেয়। নতুন পোশাক পরে। মিষ্টি বিতরণ করে। সারা ভারত জুড়ে দীপাবলি বা দেওয়ালী। তিথি মেনে যেদিন বঙ্গে কালীপূজা হয়, তার পরদিন বাকি ভারতবর্ষে হয় দেওয়ালী। দীপাবলি অর্থাৎ প্রদীপের সমষ্টি। হিন্দুদের বিশ্বাস প্রদীপের আলোয় অমঙ্গল দূর হবে। ঘরদোর পরিষ্কার করে প্রদীপ জ্বালালে ঘরে লক্ষ্মী আসবে। আলোর পথ দেখে দেবতারা মর্তে আসবেন। এছাড়া অমঙ্গল তাড়ানোর জন্য আতসবাজি পোড়ানো হয়। পশ্চিমবঙ্গেও কালীপূজার দিন লক্ষ্মীপূজা হয়। এই প্রচলন অবশ্য পূর্ববঙ্গীয়দের মধ্যে দেখা যায় না। অমাবস্যার সন্ধ্যায় লক্ষ্মীপূজা হয়। তারপর রাতে হয় কালীপূজা। তবে যদি অমাবস্যা পরপর দুদিন সন্ধ্যা পায় তবে দ্বিতীয় সন্ধ্যাতে লক্ষ্মীপূজা হবে। এই বিধি হল ‘তিথিতত্ত্ব’র। তিথিতত্ত্বে এদিন পথ, বাড়ি, শ্মশান, নদীর তট, পাহাড়ের সানুদেশে দীপমালায় সাজানোর কথা আছে।

দীপাবলি বা দেওয়ালীতে আলো জ্বালানোর প্রথা নিয়ে অনেক তথ্য বা তত্ত্ব আছে। যেমন রামচন্দ্র ১৪ বছর বনবাস কাটিয়ে, রাবণ বধ করে সীতা ও লক্ষ্মণকে নিয়ে অয্যোধ্যায় ফিরলে অয্যোধ্যাবাসী ঘিয়ের প্রদীপ জ্বেলে সারা শহর সাজিয়ে ছিল। সেই থেকে দেওয়ালী। নরকাসুর (অপর নাম ভৌমাসুর) নামে এক অসুর ক্ষত্রিয় নৃপতিদের কাছ থেকে অপহরণ করে আনা ষোল হাজার একশত কন্যাকে প্রাগজ্যোতিষপুরের প্রাসাদে বন্দী করে রেখেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ নরকাসুরকে বধ করে তাদের উদ্ধার করেন। সেই উদ্ধার হওয়া কন্যারা শ্রীকৃষ্ণকে পতিরূপে বরণ করে নিয়েছিলেন। সেদিন হয়েছিল দ্বারকায় দীপাবলি। জৈনমতে ৫২৭ খ্রিষ্ট পুর্বাব্দে মহাবীর এদিন নির্বাণ বা মোক্ষ লাভ করেন। তাই জৈনরা এদিন প্রদীপ জ্বেলে দিনটি পালন করেন। অনেক ঐতিহাসিক বলেন, স্কন্দগুপ্ত হুনদের পরাজিত করে ভারতবর্ষকে তখনকার মতো রক্ষা করে ছিলেন। তখন ভারতবাসীরা সেদিনের জয়কে স্মরণীয় করে রাখতে দীপ জ্বালিয়ে ছিল। জাহাঙ্গীর শিখদের ষষ্ঠ গুরু হরগোবিন্দকে আক্রমণাত্মক কার্যকলাপের জন্য গোয়ালিয়র দুর্গে বন্দী করে রাখেন। সঙ্গে ছিল তাঁর ৫২ জন অনুগামী। পরে জাহাঙ্গীরের মন পরিবর্তন হয়। আনুমানিক ১৬১৯ খ্রিষ্টাব্দে তাদের মুক্তি দেন জাহাঙ্গীর। সেই দিনটি হল শিখদের দীপাবলি।

বাংলায় যে দীপান্বিতা কালীপূজা হয় তা পালন হয় কাশীনাথের রচিত কালীসপর্যাবিধি (১৭৬৮) অনুসারে। বাংলায় দীপান্বিতা কালীপূজা প্রচারের কৃতিত্ব দেওয়া হয় নবদ্বীপের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় এবং তাঁর পৌত্র ঈশানচন্দ্র রায়কে। তারাই প্রজাদের কালীপূজা করতে উদ্বুদ্ধ করেন। মৎস্যসুত্র অনুযায়ী সর্বশাস্ত্র অপেক্ষা তন্ত্রশাস্ত্র শ্রেয়। তন্ত্রশাস্ত্র অনুযায়ী কাজ করলে দেবতা বশীভূত হয়, দেবতা বশীভূত হলে কোনও কার্য্য অসাধ্য থাকে না। দুর্গা ও কালী, এই দুই পৃথক মাধ্যমে শক্তির সাধনা করা যায়। কিন্তু দুর্গাপূজাতে উৎসবের প্রাধান্যের জন্য সাধনের ক্ষেত্রে কালীপূজা প্রাধান্য লাভ করে বাঙালীদের মধ্যে। কালীকে অবলম্বন করে বাংলার তন্ত্রসাধনা, এটাই ছিল মুখ্য। যদিও আজ বাঙালীর কালীপূজা দীপাবলি উৎসবের রূপ নিয়েছে। তন্ত্রমতে কালীর বাহন কবন্ধ অর্থাৎ মস্তকবিহীন শবদেহ। বাংলায় যেরূপে পূজা হয় তাতে কালী শিবের ওপর দণ্ডায়মান। অনেকের মতে এই রূপ প্রচলন করেন প্রায় ৫০০ বছর আগে নবদ্বীপের তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। এই রূপের একটি লৌকিক গাথা আছে। অসুরদের প্রধান ছিলেন রক্তবীজ। ব্রহ্মার বরে তার রক্ত মাটিতে পড়লেই জন্ম নিচ্ছে অসংখ্য অসুর। তাই কালী রক্তবীজের ঝাড়দের বধ করার জন্য তাদের রক্ত জিভ দিয়ে পান করতে থাকেন যাতে একবিন্দু রক্ত মাটিতে না পড়ে। এই রক্তপান করতে করতে মায়ের হিতাহিত জ্ঞান লোপ পায়। সেই ঘোরে মা নরকুলকেও ধ্বংস করতে থাকেন। তখন দেবতাদের অনুরোধে শিব এসে কালীর চলার পথে শুয়ে পড়েন। শিবের গায়ের ওপর পা পড়ার পর কালী নিচের দিকে তাকান। তখন মা কালী শিবকে দেখে লজ্জায় জিভ বার করে ফেলেন। যদিও শাক্ত সাধকদের মতে শিব নির্গুণ ব্রহ্মের প্রতীক। শিব মায়ের পদতলে শববৎ পড়ে রয়েছেন। শিবের চৈতন্য শক্তি হলেন মা কালী। জগতের সৃষ্টি, স্থিতি, লয় মায়ের শক্তিতে সম্পন্ন হয়।

দীপাবলি উৎসবের শেষ উৎসব হল ভাইফোঁটা। এর পোশাকি নাম ‘ভ্রাতৃ দ্বিতীয়া’। কালীপূজা অমাবস্যায় আর শুক্লা দ্বিতীয়ায় ভাইফোঁটা। পশ্চিম ভারতে ও উত্তর ভারতে হয় ‘ভাই দুজ’। মহারাষ্ট্রে, গোয়া, কর্ণাটকে বলে ‘ভাই বিজ’। নেপালে এবং দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলে এর পরিচিতি ‘ভাই টিকা’ বলে। এই উৎসবের আরেক নাম যম দ্বিতিয়া। কথিত আছে, এইদিন মৃত্যুর দেবতা যম তাঁর বোন যমুনার হাতে ফোঁটা নিয়েছিলেন। অন্যমতে কৃষ্ণ যখন নরকাসুরকে বধ করে দ্বারকায় ফেরেন, তখন কৃষ্ণের বোন সুভদ্রা তাঁর কপালে ফোঁটা দিয়ে মিষ্টিমুখ করিয়ে স্বাগতম জানান। সেই থেকে ভাই ফোঁটার প্রচলন। এই দিন বোনেরা ভাইদের ফোঁটা দিয়ে দীর্ঘ জীবন কামনা করে। ভাই বোনকে সাধ্যমত উপহার দেয়।

মহালয়ার পর বাংলায় যে শারদ উৎসব শুরু ভাইফোঁটার পর সেই উৎসবের সমাপ্তি হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো খুলে যায়। হেমন্তে জমিতে ফসল পেকে যায়। ছেলে বুড়ো সবাই আবার কর্ম চঞ্চল ওঠে। “আসছে বছর আবার হবে”, এই প্রত্যাশা নিয়ে সবাই বুক বাঁধে।