কলকাতা ব্যুরো: নেই আগের মতো জৌলুস, নেই জনসমাগমও। করোনা কাঁটায় ছাঁটতে হয়েছে যাবতীয় আড়ম্বর। শুধু নিয়মরক্ষাটুকুই রয়েছে। কড়া কোভিডবিধি মেনে মকর সংক্রান্তিতে পুন্যস্নানের পাশাপাশি এবার অনেকটাই ছোট করে হচ্ছে জয়দেব-কেন্দুলি মেলা। অজয় নদের চরের পাশাপাশি রাধবিনোদ মন্দির ঘিরে এই মেলা বসেছে। কঠোরভাবে নিয়মকানুন যাতে মেনে চলা হয়, তার জন্য একাধিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে জেলা প্রশাসন। মেলায় কোভিড সেন্টারের পাশাপাশি থাকছে একাধিক চেক পয়েন্ট। তবে রাজ্যে প্রতিদিন যে হারে করোনা সংক্রমণ বেড়ে চলেছে তা মধ্যেই জয়দেবের মেলা কতটা বাস্তবিক তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে মেলা কখনোই সাধারণ মানুষের জীবনের থেকে বেশি প্রাধান্য পেতে পারে না। একেই রাজ্যে করোনার দাপট মাথায় চড়েছে, তারওপর মেলা-অনুষ্ঠান সংক্রমণকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।
রাজ্যের ক্ষুদ্র কুটিরশিল্প ও বস্ত্রমন্ত্রী তথা স্থানীয় বিধায়ক চন্দ্রনাথ সিনহা বলেন, ”এই মেলা আউলবাউলের মেলা। মূলত তাঁদের কথা ভেবে এই মেলা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এবার মেলা হবে কোভিডবিধি মেনে। সবাই যেন মাস্ক পরে আসেন, সেই অনুরোধ করা হচ্ছে বারবার। প্রশাসনের তরফে নজরদারি চালানো হবে।”
বীরভূমের ইলামবাজার ব্লকের জয়দেব পঞ্চায়েতে অজয় নদের পাড়ে জয়দেব-কেন্দুলি গ্রাম। এটিই কবি জয়দেব জন্মস্থান। বারো-তেরো শতকে রাজা লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি ছিলেন কবি জয়দেব। সংস্কৃতে ‘গীতগোবিন্দ’ রচনা করেই সমাদৃত হন। সেসময় মূলত তাঁর উদ্যোগেই জয়দেব-কেন্দুলি সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসাবে গড়ে ওঠে। বিভিন্ন ধর্মের আলোচনার পাশাপাশি এখানে তৈরি হয় একাধিক মঠ।
পরে বর্ধমানের মহারানি ব্রজকিশোরীর উদ্যোগে ১৬৮৩ সালে জয়দেবে রাধবিনোদ মন্দির তৈরি করা হয়। ফি-বছর জানুয়ারি মাসে জয়দেবে মেলা বসে, সেখানে দেশ বিদেশ থেকে কয়েক হাজার বাউল,ফকির এই মেলাতে ভিড় জমান। এছাড়াও জয়দেবে একাধিক মঠ ও আশ্রম রয়েছে সেখানেও বাউলেরা থাকেন। শতাব্দী প্রাচীন এই মেলার বৈশিষ্ট্য়, এখানে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ আসেন ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে। মেলার বড় অংশ বসে একাধিক আখড়া। সেখানে মেলা কয়েক দিন চলে ধর্ম প্রাচার এবং আলোচনা। বাউল, কীর্তন এবং সুফি গানের আসর বসে। বিভিন্ন আখড়ায় বিনামূল্যে মেলে দু’বেলা ভোগ।
কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে এবছর সেই মেলা ছোট করে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জেলা প্রশাসন। থাকছে মকর সংক্রান্তির ভোরে অজয় নদে পুণ্যস্নান। এদের জন্য অজয়ে দুটি ঘাট তৈরি করা হচ্ছে। বাইরের পুণ্যার্থীদের স্নানের অনুমতি দেওয়া হবে না। এবছর মেলা মকরসংক্রান্তির দিন পুণ্যস্নান দিয়ে শুরু হয়েছে। অজয়ের চরে এবং মন্দির সংলগ্ন এলাকায় মেলা বসেছে। থাকছে দোকান। পুরোটাই হবে কোভিড বিধি মেনে।
অজয়ের তীরে দুটি স্নান ঘাট তৈরি করা হয়েছে। মেলায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা কড়াকড়ি করতে এবার ৫০টি সিসিটিভি বসানো হয়েছে মেলা জুড়ে। মেলাতে ঢোকার আগে যেখানে পাকিং থাকবে সেখানে ড্রপ গেট থাকবে। এই রকম ১২টি ড্রপ গেট থাকবে মেলাতে। পানীয় জলের ব্যবস্থা করা হয়েছে পর্যাপ্ত।
ইলামবাজার ব্লকের বিডিও শেখ জসীমউদ্দিন বলেন, মেলাতে যাতে করোনা বিধি মানা হয় তার জন্য মেলাতে করোনা সেন্টার থাকবে। মাস্ক, স্যানিটাইজারের পর্যাপ্ত ব্যবস্থার পাশাপাশি নিরাপত্তার জন্য় সিসিটিভি থাকবে।
তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় এই বছর জয়দেব মেলায় তুলনামূলকভাবে পুণ্যার্থী সংখ্যা কিছুটা হলেও কম। প্রশাসনের তরফে প্রথমে মেলা বন্ধের কথা ঘোষণা করা হলেও পরে ১১ জানুয়ারি সেই সিদ্ধান্ত বদল করে জানানো হয় মেলা হওয়ার কথা। প্রত্যেক বছর মকর সংক্রান্তির দিন বীরভূমের জয়দেবে অনুষ্ঠিত হয় কেন্দুলি মেলা। যেখানে প্রত্যেক বছর লক্ষাধিক মানুষ ভিড় করেন। কার্যত বাউলা কার্মেলা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে এই মেলাটি। মেলাজুড়ে ভরে যায় কীর্তনিয়া, বাউল শিল্পীদের আখাড়াতে।