বাবা তাঁকে সন্তানের স্বীকৃতি দেয়নি।যাদের স্বামী নেই, তাদের জন্য যে বিশেষ হাসপাতাল সেখানেই তাঁর জন্ম। তাঁর মা হয়তো তাঁকে হাসপাতালে রেখেই পালাতেন, কিন্তু তাঁর মনে ক্ষীণ আশা ছিল মেয়ের বাবা ফিরে আসবেন এবং তাকে বিয়ে করবেন। বাবা অবশ্য হাসপাতালে এসে নিজের মেয়েকে দেখেছিলেন এবং পিতৃত্ব স্বীকারের কাগজে সইও করেছিলেন। তারপর নিজের মায়ের নামে মেয়ের নাম রেখে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে ফিরে চলে গিয়েছিলেন। এই জন্ম বৃত্তান্তই বলে দেয়, সোফিয়া লরেন হওয়াটা একেবারেই সহজ ছিল না। বরং এর জন্য তাঁকে পাড়ি দিতে হয়েছে অনেক চড়াই-উতরাই। বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইতালিতে কঠিন দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে। কিন্তু বাবার পরিচয় ছাড়া বড় হয়ে সোফিয়া লরেন পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় অভিনেত্রী হয়েছেন।

UNITED KINGDOM – AUGUST 01: Sophia Loren In South Wales On August 1965 (Photo by Keystone-France/Gamma-Keystone via Getty Images)

সোফিয়ার তখন ১৪ বছর বয়স। সে সময় ইতালির এক সুন্দরী প্রতিযোগিতায় নাম লেখান তিনি। আপাদমস্তক সুন্দরী সোফিয়া সহজেই পৌঁছে যান ফাইনালিস্টদের তালিকায়। তারপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। মজার বিষয়, ওই প্রতিযোগিতায়ই সোফিয়া দৃষ্টি কাড়েন ৩৭ বছর বয়সী চলচ্চিত্র পরিচালক কার্লো পন্টির। তিনিই সোফিয়াকে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুযোগ করে দেন। পরবর্তীতে সেই পন্টিকেই বিয়ে করেন সোফিয়া।চলচ্চিত্রে অভিষেকের পরই সোফিয়া সাইক্লোন থেকে সোফিয়া লরেন হয়ে যান। ১৯৫২ সালে ‘লা ফ্যাভোরিটা’ এবং ১৯৫৩ সালে ‘এইডা’ নামের ছবিতে অভিনয়ের পরপরই সোফিয়ার সামনে হলিউডের দরজা খুলে যায়। সোফিয়া লরেনের ক্যারিয়ার শুরু বাজার চলতি যৌন পত্রিকার মডেল হিসেবে। চলচ্চিত্রে তার অভিষেক ১৯৫০ সালে। এখানেও তার শুরুটা সম্মানজনক ছিল না। এভাবে শুরু করে এতটা অসাধারণ জনপ্রিয়তা ও আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন চলচ্চিত্র ইতিহাসে বিরল। দীর্ঘ অভিনয় জীবনে তিনি ১০০টির বেশি সিনেমায় অভিনয় করেন। 

Operation Crossbow (1965) Directed by Michael Anderson Shown: Sophia Loren

মাত্র ১৪ বছর বয়সে মডেল হিসেবে বিনোদন জগতে যাত্রা শুরু হয় তার। চলচ্চিত্র প্রযোজক কার্লো পন্টির সঙ্গে পরিচয়ের পর অভিনয় জগতে পা রাখেন সোফিয়া। সোফিয়া লরেন অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র ‘আই অ্যাম ক্যাপাটাজ’। পরে ‘সানফ্লাওয়ার’, ‘হাউসবোট’, ‘ইয়েস্টারডে, টুডে অ্যান্ড টুমরো’, ‘ম্যারেজ ইতালিয়ান স্টাইল’, ‘এল সিআইডি’, ‘দ্য ফল অব দ্য রোমান এম্পায়ার’, ‘ম্যান অব লা মাঞ্চা’, ‘দ্য কাসান্ড্রা ক্রসিং’, ‘এ স্পেশাল ডে’সহ অসংখ্য ছবি উপহার দিয়েছেন এই অভিনেত্রী। সফিয়ার মায়ের জীবন নিয়ে একটা ছবি তৈরি হয়। ‘রোমিলডা’ নামের সেই ছবিতে সোফিয়া মা ও মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় করে সাড়া জাগিয়েছিলেন। ‘ও ম্যান অব দ্য রিভার’ ছবির মাধ্যমেই সোফিয়া লরেন ইতালির সেরা অভিনেত্রীর সম্মান লাভ করেছিলেন। ‘আফ্রিকা আন্ডার দ্য সি’ ছবিতে অভিনয় করে তিনি ব্যাপক খ্যাতি পেয়েছিলেন। রানী এলিজাবেথ ছবিটি দেখে এতই মুগ্ধ হলেন যে, তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।

Italian actress Sophia Loren at the Savoy Hotel in London, England, for a press conference on her upcoming film ‘A Countess from Hong Kong’, 1st November 1965. The film will be written and directed by Charlie Chaplin. (Photo by Fox Photos/Hulton Archive/Getty Images)

ভেট্টোরিও ডি সিকা পরিচালিত ‘টু উইমেন’ ছবিতে অভিনয়ের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৬২ সালে অস্কার পেয়েছিলেন সোফিয়া লরেন। বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্রের অভিনয়শিল্পী হিসেবে তিনিই প্রথম সেই অস্কার পেয়েছিলেন। ১৯৮০ সালে এই অভিনেত্রীর জীবন নিয়ে নির্মিত হয়েছিল ‘সোফিয়া লরেন: হার ওন স্টোরি’। ২০০৭ সালে স্বামী কার্লো পন্টিকে হারান এই অভিনেত্রী। তার দুই ছেলে কার্লো পন্টি জুনিয়র ও অ্যাডৌরা পন্টি। সোফিয়া লরেন সর্বশেষ অভিনয় করেছিলেন ২০০৯ সালে, ‘নাইন’ ছবিতে। ষাট ও সত্তর দশকে সোফিয়া লরেন ছিলেন বিশ্বের জনপ্রিয় অভিনেত্রীদের অন্যতম। ইউরোপ ও আমেরিকায় তিনি সমান তালে অভিনয় করেন পল নিউম্যান, মার্লন ব্র্যান্ডো, গ্রেগরি পেক, চার্লটন হিউস্টনদের মতো অভিনেতাদের সঙ্গে। অস্কার তো বটেই, জিতে নেন পাঁচটি গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ড। আশির দশকের শুরু থেকেই চলচ্চিত্রে অভিনয় কমিয়ে দেন সোফিয়া। সময় কাটান স্বামী-সন্তানদের সঙ্গে।

বহু বিখ্যাত ছবিতে ইতালিয়ান এই রূপসীর অনিন্দ্য রূপ দ্যুতি ছড়ালেও  মনে করতেন, সোফিয়ার নাকটা একটু বেশি লম্বা। একেবারের গোড়ার দিকে লম্বা নাক নিয়ে বেশ সমস্যায় পড়তে হয়েছিল সোফিয়াকে। সেই নাক যথাযথভাবে ক্যামেরাবন্দি করাটা  চিত্রগ্রাহকদের কাছে সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।  নাকের মাপ কমানোর জন্য  তাঁরা সোফিয়াকে অস্ত্রোপচার করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। সোফিয়ার স্বামী কার্লো পন্টিও একই অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু কারও কথায় কান দেননি সোফিয়া। নিজের মুখশ্রী নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন তিনি। ৮০ বছর বয়সী সোফিয়া বলেছিলেন, ‘চিত্রগ্রাহকরা বারবার আমার নাকের দিকেই আঙুল তুলতো। তারা বলতেন, আমার নাকটা নাকি মাত্রাতিরিক্ত লম্বা আর মুখটা নাকি বেশ বড়। কার্লোরও একই মত ছিল। ও বলেছিল, ‘সবাই যখন বলেছে তখন সামান্য একটা অস্ত্রোপচার করিয়ে নিলেই তো হয়।’ কিন্তু আমি কিছুতেই রাজি হইনি। ওদেরকে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলাম, কিছুতেই অস্ত্রোপচার করাবো না।

১৯৮০ সালে সোফিয়া লরেনের জীবনী অবলম্বনে নির্মিত হয়েছিল ‘সোফিয়া লরেন: হার ওন স্টোরি’। ১৯৯৪ সালে প্রায় ৬০ বছর বয়সে সোফিয়া অভিনয় জগতে ফিরে আসেন। ‘প্রিট-আ-পোর্টার’ নামের ছবিতে বক্স অফিস কাঁপিয়ে আবারও দশর্কদের মুগ্ধ করেন তিনি। সোফিয়া সর্বশেষ অভিনয় করেছিলেন ২০০৯ সালে, ‘নাইন’ ছবিতে। সে যেন রূপকথার প্রত্যাবর্তন। চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে আবারও বড়পর্দায় ফেরেন সোফিয়া লোরেন। ছেলে এডওয়ার্ড পন্টি পরিচালিত একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন হলিউডের অভিনেত্রী সোফিয়া লরেন। একক নাটক ‘দ্য হিউম্যান ভয়েস’ অবলম্বনে নির্মিত ছবিটির মাধ্যমে ফের ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান অস্কারজয়ী ইতালীয় অভিনেত্রী। 

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version