লোকসভায় দুই কক্ষে ওয়াকফ সংশোধনী আইন ২০২৫ পাশ হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু তাতে সই করে দেওয়ায় তা আইনে পরিণত হয়েছে। কিন্তু সংশোধিত আইনের প্রতিবাদে বাংলায় সংখ্যালঘুদের একাংশ প্রবল বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে। ওয়াকফ সংশোধনী আইন প্রত্যাহারের দাবিতে গত কয়েকদিন ধরেই রাজ্যের জেলায়-জেলায় প্রবল প্রতিবাদর স্রোত আছড়ে পড়েছে। শহর কলকাতাতেও বিক্ষোভের আঁচ পড়েছে। তবে গোটা রাজ্যের মধ্যে ওয়াকফ আইন নিয়ে সবচেয়ে বেশি অশান্তি ছড়িয়েছে মুর্শিদাবাদে। হিংসা শুরু হয়েছিল ওই জেলার জঙ্গিপুর থেকে, তারপর একে একে সুতি, সামশেরগঞ্জ, ধুলিয়ানে ছড়িয়ে পড়ে। হিংসায় বেপরোয়াভাবে সরকারি-বেসরকারি সম্পত্তি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের মতো চূড়ান্ত ঘটনার খবর পাওয়া যায়। বিক্ষোভের জেরে দুজনের মৃত্যু হয়েছে বলে খবর। মুর্শিদাবাদের অশান্তি বিধ্বস্ত জায়গাগুলিতে পরিস্থিতি সামাল দিতে ইতিমধ্যেই পুলিশের সঙ্গে বিএসএফ টহল দিতে শুরু করেছে। কলকাতা হাইকোর্ট ইতিমধ্যে মুর্শিদাবাদে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছে। শনিবার হাইকোর্টের বিচারপতি সৌমেন সেন এবং বিচারপতি রাজা বসুচৌধুরীর বিশেষ ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়েছে, এরকম অভিযোগ এলে আদালত চোখ বন্ধ করে থাকতে পারে না।
প্রসঙ্গত, ওয়াকফ বিল দেশে আইনে পরিণত হওয়াতে কোটি কোটি মূল্যের যাবতীয় ওয়াকফ সম্পত্তি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করা হবে, তার পুরো পদ্ধতিটাই গিয়েছে বদলে। মুসলিম সমাজ-সহ বিরোধিদের বক্তব্য, এই বিলটি চূড়ান্ত অসাংবিধানিক এবং দেশের সংখ্যালঘু নাগরিকদের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করছে। অন্যদিকে কেন্দ্র তথা বিজেপি সরকারের যুক্তি, দেশে মুসলিমদের ওয়াকফ সম্পত্তির পরিচালনা পদ্ধতিকে স্বচ্ছ্ব ও দুর্নীতিমুক্ত করে তুলতেই এই আইনটি প্রণয়ন করা দরকার ছিল। ভারতে ওয়াক্ফ বোর্ডে দুর্নীতি যে রয়েছে সেকথা মুসলিম সমাজের প্রতিনিধিরাও স্বীকার করেন। উল্লেখ্য, বিচারপতি রাজেন্দ্র সাচার কমিটি (২০০৬)-এর বক্তব্য, বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও ওয়াক্ফ বোর্ডের রাজস্ব ছিল খুবই কম। কমিটি জানায়, যদি জমিগুলি কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যায়, তাহলে প্রতিবছর প্রায় ১২ হাজার কোটি রুপি আয় করা সম্ভব। অথচ বর্তমানে বার্ষিক আয় মাত্র ২০০ কোটির মতো। কিন্তু ওই কমিটির রিপোর্ট থেকে এও জানা যায় যে, ওয়াক্ফ-এর রক্ষণাবেক্ষণ করে রাষ্ট্র যে নিজেই বহু জমি দখল করে রেখেছে। সরকার বলছে, সংশোধীত ওয়াক্ফ আইন এইসব সমস্যার সমাধান করবে এবং সাচার কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নে সহায়তা করবে। কিন্তু তাতেও আশঙ্কা থাকছে কারণ, মালিকানাসংক্রান্ত নীতি পরিবর্তনের ফলে ঐতিহাসিক মসজিদ, দরগা ও কবরস্থানের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। এগুলির একটা বড় অংশ বহু প্রজন্ম ধরে ব্যবহৃত হলেও বেশির ভাগেরই কোনো লিখিত দলিল নেই। অনেক ক্ষেত্রে অন্তত একশো বছর আগে মৌখিকভাবে কিংবা প্রমাণ ছাড়া দান করা হয়েছে।
আরেকটি উদ্বেগজনক বিষয় হল, সংশোধিত আইনে ওয়াক্ফ বোর্ডে এখন থেকে অমুসলিম সদস্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বোর্ডে সব ধর্মের মানুষ রাখা বাধ্যতামূলক করার আইন গ্রহণযোগ্য হতেই পারে যদি তার প্রক্রিয়াকে ধর্মনিরপেক্ষ করে তোলা যায়। কিন্তু ওয়াকফের ক্ষেত্রে যেভাবে সেটা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা হচ্ছে, তাতে সংখ্যাগরিষ্ঠের রাজনৈতিক সুবিধা হবে। কারণ, শুধু তো রাষ্ট্রের মাধ্যমে মুসলমানদের সম্পত্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ নয়, বরং হিন্দু সমাজের মাধ্যমে মুসলিম সমাজ জীবনের উপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা। কারণ, এদেশে হিন্দু মন্দির পরিচালনা কমিটিতে অন্য ধর্মাবলম্বীরা স্থান পায়না। তাহলে ওয়াক্ফ বোর্ডে অমুসলিমদের রাখা হবে কেন? স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে ওয়াক্ফ সংশোধোনী আইন আসলে এদেশে মুসলমান ও অন্যান্য সংখ্যালঘু ধর্মের মানুষের বিরুদ্ধে হিন্দুত্ববাদীদের বৈষম্য ও নিপীড়নের পদক্ষেপ।
উল্লেখ্য, আগস্ট মাসে বিজেপি জোট সরকার ওয়াকফ আইন সংশোধনের জন্য আনা বিলে জানিয়েছিল, ওয়াক্ফ প্রশাসন আধুনিক এবং আইনের ফাঁকফোকরগুলি বন্ধ করতেই এই বিলটির প্রস্তাবনা। কিন্তু তখন থেকেই কেবল দেশের মুসলিম নেতারা নয়, বিরোধী দলগুলিও বলেছিল, বিজেপি সরকার মুসলিমদের সম্পত্তি আরও বেশি করে কুক্ষিগত করতে সংশোধনী আনতে চাইছে। ওয়াক্ফ আইনের নতুন সংশোধনীতে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হল কোনটিকে ওয়াক্ফ সম্পত্তি বলে চিহ্নিত করা হবে, সেই সংজ্ঞাটাই পাল্টে দেওয়া! ঐতিহাসিকভাবে দেশের বহু বাড়ি থেকে জমি এতকাল আইনগতভাবে বৈধ ওয়াক্ফ সম্পত্তি বলে স্বীকৃতি পেয়ে এসেছে কেবল মুখের কথায় বা ওরাল ডিক্লারেশনে। এখন নতুন আইনে কোনো সম্পত্তিকে ওয়াক্ফ বলে দাবি করতে হলে ওয়াক্ফ বোর্ডকে তার স্বপক্ষে বৈধ নথিপত্র জমা দিতে হবে। আবার সেই জমি যদি সরকারি মালিকানাধীন বা খাস জমি হয় তাহলে তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারবে সরকার। নতুন আইনে অমুসলিম ব্যক্তিরাও ওয়াক্ফ বোর্ড ও ট্রাইব্যুনালের সদস্য নিযুক্ত হতে পারবেন। এতদিন ওয়াক্ফ সম্পত্তি নিয়ে কোনো বিতর্কের ক্ষেত্রে ওয়াক্ফ ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তই ছিল চূড়ান্ত। কিন্তু নতুন আইনে বিচারবিভাগীয় হস্তক্ষেপেরও সুযোগ রাখা হয়েছে। অর্থাৎ, কোনো পক্ষ চাইলে আদালতের দ্বারস্থ হতে পারবে। এছাড়া নতুন আইনে দেশের সব ওয়াক্ফ সম্পত্তির জন্য একটি ‘সেন্ট্রালাইজড রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম’ গঠনেরও প্রস্তাব রয়েছে। তার মানে এখন সমস্ত ওয়াকফ সম্পত্তিকে ওই রেজিস্টারে নথিভুক্ত করাতে হবে।
তাছাড়া নতুন কোনো সম্পত্তি যদি ওয়াক্ফ হিসেবে নথিভুক্ত করাতে হয়, সেক্ষেত্রেও এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই সংশ্লিষ্ট ওয়াক্ফ বোর্ডের কাছে আবেদন পেশ করতে হবে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে সরকারের ভূমিকা এখন থেকে আগের চেয়ে অনেক বেশি থাকবে, বস্তুতপক্ষে সরকারই ওয়াক্ফ বোর্ডের চেয়ে বেশি ক্ষমতাশালী হবে। অর্থাৎ এদেশের জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ বা প্রায় ২০ কোটি মুসলমানের ধর্মীয় ঐতিহ্য, অধিকার, সংস্কৃতির উপর বিজেপি সরকারের আইনকে অপব্যবহারের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে, যা ইসলামী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলি পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যাপক বিপর্যয় ঘটাবে। এদেশে সামরিক বাহিনী ও রেলওয়ের পর ওয়াকফ মালিকানাধীন জমির পরিমাণই সবথেকে বেশি। নতুন ওয়াকফ আইন কাজে লাগিয়ে বিজেপি সরকার যে ওয়াকফ সম্পত্তি যে অবাধে নিয়ন্ত্রণ করবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, আর সেটাই হবে মুসলিমদের উপর চরম আঘাত। সব মিলিয়ে ওয়াকফ সংশোধনী আইন ভারতের হিন্দুত্ববাদী সরকারের চরম মুসলিম বিরোধী পদক্ষেপ।