রাজনৈতিক সংঘর্ষের কারণে বাংলার মাটি বহুবারই রক্তে ভেসেছে। কখনো গোষ্ঠীদ্বন্দের জেরে খুন, কখনো বদলার রাজনীতিতে গণহত্যা। রামপুরহাটের বগটুই গ্রামের ঘটনার আগেও গত বিশ বছরে বাংলা অন্তত ৬টি গণহত্যার সাক্ষী থেকেছে। ২০০০ সালের ২৭ জুলাই রাজনৈতিক সংঘর্ষে বীরভূমের নানুর-সূচপুরে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছিল। বাম জমানায় ওই ঘটনার কয়েক মাস কয়েক পরেই ২০০১ সালের ৪ জানুয়ারি বাংলা রক্তাত্ত হয়েছিল ছোট আঙারিয়ার গণহত্যায়। এরপরে ২০০৭ সালের ১৪ মার্চ ঘটে নন্দীগ্রাম গণহত্যা। পুলিশের গুলিতে মারা যান ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির ১৪ জন। ওই বছরই ১০ নভেম্বর নন্দীগ্রামে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির দখলে থাকা এলাকা দখলে সিপিএমের গুলিতে মারা যান ১০ জন। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি লালগড় ব্লকের নেতাই গ্রামে দুষ্কৃতিদের গুলিতে মারা যান ৯ জন। গুলি চলেছিল ওই গ্রামের সিপিএম নেতা রথীন দণ্ডপাতের বাড়ি থেকে। প্রশ্ন; স্রেফ রাজনৈতিক কারনেই কি বাংলার মাটি রক্তে ভেজে ?
সোমবার সন্ধ্যায় রামপুরহাটের বগটুই মোড়ে বড়শাল পঞ্চায়েতের তৃণমূল উপপ্রধান ভাদু শেখ খুন হওয়ার পরই অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে রামপুরহাট। ‘বদলা’ নিতেই পরপর কয়েকটি বাড়িতে জ্বলে ওঠে আগুন। সেই আগুনে পুড়েই এখন পর্যন্ত মহিলা, শিশু-সহ কমপক্ষে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে খবর। কে বা কারা খুন করল ভাদু শেখকে? পরবর্তীতে কারাই বা পাল্টা আগুন লাগালো বগটুই গ্রামের একাধিক বাড়িতে যার কারণে অতগুলি প্রাণ ছাই হল?
বগটুই ঘিরে বঙ্গ রাজনীতি যতই তোলপাড় হোক না কেন সেই প্রশ্নটাই কিন্তু ঘুরে ফিরে সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে- শুধুমাত্র রাজনীতিই কি গণহত্যার একমাত্র কারণ?



প্রসঙ্গত, বিরোধীদের অভিযোগ, রাজ্যের শাসকদল তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরেই খুনের ঘটনা এবং তার বদলা নিতেই অগ্নিসংযোগ ও মহিলা, শিশু-সহ দশ জনের মৃত্যু। তবে রাজ্য পুলিশ রামপুরহাটের বগটুই গ্রামের এই ঘটনার কারণ হিসাবে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বকে কারণ বলে মনে করছে না। অন্যদিকে বীরভূমের জেলা সভাপতি জানান, শর্ট সার্কিট থেকে টিভি ফেটে তিন-চারটি বাড়িতে আগুন লেগেছিল। সঙ্গে সঙ্গে দমকল গিয়ে আগুন নেভানো শুরু করে।
সোমবার সন্ধ্যায় ভাদু একটি চায়ের দোকানে বসে আড্ডা মারছিলেন। ঠিক সেই সময় কয়েকজন তাঁকে লক্ষ্য করে বোমা ছোঁড়ে। উল্লেখ্য, এই ঘটনার প্রায় ১৫ মাস আগে (২০২১ সালের ৫ই জানুয়ারি) খুন হয়েছিলেন ভাদুর ভাই বাবর শেখ। তিনিও সক্রিয় তৃণমূল কর্মী ছিলেন। সূত্রে খবর অনুযায়ী বাবর এক সময় ট্রাক্টর চালাতেন। পরে রামপুরহাট শহরে মুরগি ব্যবসায়ীর গাড়ি চালাতেন। দাদা ভাদু পঞ্চায়েতের উপপ্রধান হয়ে ক্ষমতায় এলে বাবর গাড়ি চালানো ছেড়ে ঠিকাদারি ও দাদার বিভিন্ন ব্যবসার দেখাশোনা করতেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের কথা অনুযায়ী, বড়শাল গ্রাম পছায়েতের উপপ্রধান ভাদুর একাধিক ব্যবসা নিয়ে দলের অন্য একটি গোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল অনেকদিন আগেই। সেই আক্রোশ প্রথমে পড়ে বাবর পরে ভাদুর উপর। এবার দুটি খুনের অভিযোগ উঠেছে ভাদুর বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে।


এদিকে ভাদু শেখের স্ত্রীর স্পষ্ট অভিযোগ, “আততায়ীরাও তৃণমূল। কেবল ভাদু নয়, একবছর আগে বাবরকেও ওরাই খুন করে। কিন্তু পুলিস কোনও তদন্ত করেনি, নিষ্ক্রিয় হয়ে বসেছিল। রবিবার রাতে ওরা সবার বাড়ি বাড়ি ফোন করে ধমকি দিয়ে বলে, ‘ও তো বগটুই মোড়ে থাকে, কোথায় ওঠে, কোথায় বসে, কী করে, সব তো জানি। ওর উপর বোমা ফেলব’। ওরাও তৃণমূল করত। আমার স্বামীর সাথেই থাকত। ভাদুর দাদার মৃত্যুর পর থেকে ওরা আর সাথে থাকে না”।
তার মানে ভাদু শেখ যে খুন হবেন সেই আশঙ্কা অনেক আগেই করেছিলেন তাঁর স্ত্রী। প্রশ্ন ভাদুর খুনিরাই যদি বাবরকে খুন করে থাকে তাহলে অভিযুক্তরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে কিভাবে, ভাদুর স্ত্রী স্পষ্ট জানিয়েছেন, পুলিস কোনও ব্যবস্থা নেয়নি বলে। তাছাড়া তিনি তৃণমূল দলকেও তাঁর অভিযোগ জানান। কিন্তু পুলিশ বাবরের ঘটনায় যেমন কোনও তদন্ত করেনি নিষ্ক্রিয় থেকেছে এবারও সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে বলে অভিযোগ তুলেছেন।
প্রশ্ন পুলিশ পিকেট থাকা স্বত্বেও কিভাবে গ্রামে দুষ্কৃতীরা রাতভর তাণ্ডব চালালো, একাধিক বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ঘটালো। পুলিশ যখন সাত জনের মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করছে তখন দমকলের পক্ষ থেকে জানানো হয় ১০ জনের দেহ উদ্ধার হয়েছে। গ্রামের মানুষ প্রকাশ্যে জানাচ্ছেন তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরেই খুন এবং বাড়ি বাড়ি আগুন লাগিয়ে গণহত্যা আর রাজ্য পুলিশ তোতা পাখির বুলি আওড়ে বলছে ওসব নয়, অন্য রাজনৈতিক কারণ। কিন্তু কি সেই রাজনৈতিক কারণ যার জন্য মহিলা, শিশু-সহ দশটি তাজা প্রাণ একই রাতে পুড়িয়ে মারা হল?
4 Comments
বঙ্গ রাজনীতিতে খুনের আমদানি হয়েছিল কংগ্রেসিদের হাত ধরে, গত ষাটের দশকের শেষ দিকে নকশাল নিধন যজ্ঞে অবশ্য সিপিএমও হাত লাগিয়েছিল। বদলার রাজনীতি শুরু হলে নকশালদের হাতে সিপিএমও খুন হয়েছিল। তবে খুনের রাজনীতিতে সিপিএমের চেয়ে পারদর্শী আজ যে আর কেউ নেই তা ৩৪ বছরের জমানায় একটার পর একটা গণহত্যা প্রমাণ করেছে। আসলে খুনি আর সিপিএম সমার্থক, সাতের দশকে সিপিএমের জায়গায় ছিল কংগ্রেস, পরবর্তীতে সিপিএম কংগ্রেসিদের শিশু করে দিয়েছে। আজ সিপিএম, কংগ্রেস থেকে যে তৃণমূল নামক দলটি তারাও কালে কালে মনে হচ্ছে সিপিএম কংগ্রেসকে লজ্জায় ফেলবে।
একই রাজনৈতিক দলের মধ্যে আরেক দল বা গোষ্ঠীর অস্তিত্ব কংগ্রেস আমল থেকেই ছিল। সেটা স্বাধীনতা পরবর্তী কালে প্রসারিত হয়েছিল ঠিকই তবে তার অনেক আগে থেকেই ছিল। বামেদের মধ্যে দলাদলি বা গোষ্ঠীবাজি আটের দশক থেকেই বেশ জাকিয়ে ওঠে, এবং এক সময় বাম রাজনীতির চর্চায় সেই গোষ্ঠীবাজিই প্রাধান্য পেতে থাকে। বাংলার রাজনীতিতে খুন হত্যা ছিল, রাজনীতির কারণে, ক্ষমতা দখলের কারণে, পেশী শক্তি জাহিরের কারণে, ধীরে ধীরেতা জল ভাত হয়ে যায়।
প্রতিটি ভোট ভিক্ষে করা দলেই ভাড়াটে খুনি পোষা হয়, খুনিরা প্রয়োজন অনুযায়ী কাজ করে দেয় বিনিময়ে তাদের সব আবদার রক্ষা করে দল তা অন্যায় আবদার হলেও, কিন্তু একদিন প্রয়োজন ফুরোয়, তখন দলের অন্য খুনি দিয়ে দরকার ফুরনো খুনিদের খাল্লাস করা হয়। এই রেওয়াজ বাম অবাম সব ভোট ভিখারি দলেই যুগের পর যুগ চলছে আর আমরা হায় হায় করছি।
বগটুই গ্রামের ঘটনায় সামাজিক মাধ্যমে মধ্যবিত্ত কেরানি, শিক্ষক, অন্যান্য চাকুরেরা বীরত্ব প্রদর্শন করছেন কিন্তু তাতে যে কিছুই যায় আসে না তা তারা ভালই জানেন, বুদ্ধিজীবীদের যারা সমালোচনা করছেন তারাও বুদ্ধিজীবীদের পা চাটা যেমন বুদ্ধিজীবীরা সরকারের দালাল। রাজনৈতিক দিক থেকে অবলুপ্ত সিপিএম-এর প্রতিবাদ হাস্যকর। একমাত্র পথ রাজনীতি আর সে পথে যেতে রাজি নন কেউ কারণ অনুশীলনে আমাদের ঘোর আপত্তি।