অচিনপুর

হাজার বছর ধরে লিভ-ইন করছে ভারতের গারাসিয়া উপজাতি

By admin

March 30, 2025

বর্তমান সময়ের ছেলেমেয়েদের অনেকই বিয়েকে ঝামেলা মনে করে। তারা মনে করে নানা কারণেই দীর্ঘদিন ধরে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখাটা বেশ কষ্টকর। বিকল্প হিসেবে তারা পাশ্চাত্যের বিয়ের বিকল্প ‘লিভ-ইন’ সম্পর্ককেই অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়। এরকম চিন্তা এই উপমহাদেশের বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে যথেষ্ট পরিমানে হলেও অন্তত হাজার বছর ধরে এই দেশে এমন একটি উপজাতি বাস করছে যারা বিয়ে নয় বরং ‘লিভ-ইন’ সম্পর্কেই বিশ্বাস করে এসেছে। একথা জানার পর অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হলেও বাস্তব। রাজস্থান ও গুজরাটের কয়েকটি জেলায় ওই উপজাতিদের বসবাস। হাজার বছর ধরে গারাসিয়া নামের এই উপজাতিদের মধ্যে লিভ-ইন সম্পর্কের প্রচলন রয়েছে। পরিবারের লোকজনই এই ধরনের সম্পর্কের সম্মতি দেয়। এমনকি সঙ্গী খুঁজতে বসে মেলার আসরও।

মূলত গারাসিয়া উপজাতিদের বসবাস রাজস্থানের পালি, সিরোহী, উদয়পুর ও দুঙ্গারপুর জেলা এবং গুজরাটের সবরকণ্ঠ ও বনশকণ্ঠ জেলায়। যতদূর জানা যায় বিগত এক হাজার বছর ধরে তাদের মধ্যে লিভ-ইন রীতি চলে আসছে। রীতি অনুযায়ী, বিয়ে ছাড়াই কোনও জুটি একসঙ্গে থাকতে পারে। গারাসিয়া উপজাতির মধ্যে অনেকেই রয়েছে, যারা বিয়েতে বিশ্বাসী নন অর্থাৎ বিয়ে করতে চায় না। তারা ইচ্ছা করলেই বিয়ে না করে সঙ্গীর সঙ্গে ‘লিভ-ইন’ সম্পর্কে যেতে পারে। তবে লিভ-ইন করার ক্ষেত্রে তাদের যদি কোনও সন্তান জন্ম নেয় তাহলে ওই জুটিকেই সেই সন্তানের দায়িত্ব নিতে হবে। লিভ ইনের সঙ্গী খুঁজতে এখানে মেলা বসে, সেখান থেকে নিজের পছন্দমতো সঙ্গীকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়াই তাদের রীতি। পরে তারা লিভ-ইন পার্টনার হিসেবে গ্রামে ফিরে আসে। যদিও কিছু শর্তও রয়েছে। ‘লিভ-ইন’ সম্পর্ক শুরু হওয়ার আগে ছেলের বাড়ির দাবি মেনে কিছু টাকাও দিতে হয় মেয়ের পরিবারকে। কিন্তু পরে তারা বিয়ে করতে চাইলে ছেলের পরিবারকেই সব খরচ বহন করতে হয়।

জীবনসঙ্গী খুঁজে নেওয়ার অনেক উপায় আছে। কেউ দীর্ঘদিনের প্রেমিক বা প্রেমিকার সঙ্গেই লিভ-ইন করেন। কেউ আবার পরিবারের পছন্দে জীবনসঙ্গী নির্বাচন করেন। তবে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় এমন মেলার আয়োজন করা হয়, যেখানে গরাসিয়া জাতিগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েরা জীবনসঙ্গী খুঁজে নেয়। অর্থাৎ এই জাতিগোষ্ঠীতে পুরুষ এবং নারীরা বিয়ে ছাড়াই একসঙ্গে বাস করেন এবং নারীরা অনেকেই লিভ-ইন করার সময় মা হয়ে যান। নারীদের নিজের পছন্দের ছেলেকে নির্বাচন করার অধিকার থাকে, যা এই জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বিশেষ গুরুত্ব দেয়। যখন লিভ-ইন নিয়ে আমাদের আধুনিক সমাজে নানা কথা চলছে কারণ সহজভাবে অনেকেই তা মেনে নিতে পারছে না অথচ তার বহু আগে থেকেই গারাসিয়া উপজাতির মানুষদের মধ্যে লিভ-ইন রীতি বা প্রচলিত সংস্কৃতি। আদিবাসী গারাসিয়া উপজাতির অনাদিকাল থেকে বিবাহের বাইরে লিভ-ইন সম্পর্কের এই সংস্কৃতির নাম হচ্ছে দাপা। তাদের ধারণা, এই সংস্কৃতির ফলে তাদের এখানে ধর্ষণ ও যৌতুকের মতো অপরাধ হয় না।

রাজস্থান ও গুজরাটের যে কয়েকটি জেলায় গারাসিয়া উপজাতিদের বসবাস, সেখানে লিভ-ইনের সঙ্গী খোঁজার জন্য দু’দিনের মেলার আয়োজন করা হয়। এই মেলায় ছেলে-মেয়েরা একত্রিত হয় এবং যদি তারা কেউ কাউকে পছন্দ করে, তবে মেলা থেকে পালিয়ে যায়। তারপর তারা বিয়ে না করেই একসঙ্গে থাকতে শুরু করে। এই সময় তারা সন্তানের জন্মও দিতে পারে। পরে, তারা নিজেদের গ্রামের কাছে ফিরে আসে এবং তাদের বাবা-মায়েরা ধুমধাম করে তাদের বিয়ের উৎসব পালন করে।  কিন্তু কিভাবে এই সমাজে লিভ-ইন প্রথা চালু হল? বলা হয়, বহুকাল আগে এই উপজাতির চার ভাই গ্রাম ছেড়ে কোথাও অন্যত্র চলে গিয়েছিল। এর মধ্যে তিনজন ভারতীয় রীতিতে বিয়ে করেছিল, কিন্তু একজন ভাই বিয়ে ছাড়াই একটি মেয়ের সঙ্গে থাকতে শুরু করে। সেই তিন ভাইয়ের সন্তানের জন্ম হয়নি, কিন্তু চতুর্থ ভাইয়ের একটি সন্তান হয়েছিল। সেখান থেকেই এখানে লিভ-ইনে থাকার প্রথার শুরু।

কৃষিকাজ এবং দিনমজুরি হল গারাসিয়া উপজাতিদের একমাত্র জীবিকা বা আয়ের একমাত্র উপায়। ভুট্টা হল গারাসিয়া পরিবারের প্রধান খাদ্য। এছাড়াও তারা তাদের খাদ্যতালিকায় চাল, জোয়ার এবং গম রেখেছে। গারাসিয়া উপজাতীয় সম্প্রদায়ের অনেকেই সবজি, ফল ইত্যাদির মতো বনজ পণ্যও খেয়ে থাকে। রব বা রবডিকে গরাসিয়া জনগণের প্রশংসিত খাবার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তারা তাদের অনুষ্ঠানে লাপসি, মালপুয়া, চুরমা ইত্যাদি তৈরি করে। গারাসিয়া উপজাতিরা বেশিরভাগই নিরামিষভোজী এবং কোনো ধরনের অ্যালকোহলের প্রতি তাদের তেমন আসক্তি নেই। গারাসিয়া উপজাতি সমাজে যে কোনো পুরুষ চাইলেই যে কোনো নারীর সঙ্গে লিভইন সম্পর্কে যেতে পারবেন না। এজন্য তাকে যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করতে হবে। কারণ বেকার কোনো পুরুষের সঙ্গে কোনো নারী থাকতে চায় না। আবার গরাসিয়া নারীরা যদি চায়, তবে প্রথম পার্টনারের পরেও দ্বিতীয় মেলায় দ্বিতীয় পার্টনার নির্বাচন করতে পারে। হ্যাঁ, এই ধরনের স্বাধীনতাও তারা পায়, যা তথাকথিত আধুনিক সভ্য সমাজেও অনেক সময় পাওয়া যায় না। এই কারণেই এই জাতিগোষ্ঠী বিশ্বজুড়ে পরিচিত।