তিনি বাক্ দান করেন। তাই তিনি বাগদেবী।ভাষা থেকে শুরু করে তিনি সব বিদ্যা দান করেন। তাই তিনি বিদ্যার দেবী। তাঁর অন্য নাম বাণী বা ভারতী। দেবী ভাগবত অনুসারে সরস্বতী হলেন ব্রহ্মার পত্নী।
সরস্বতী মূলত পূজিতা হতেন পতিতাপল্লীতে। এটা কোনওনতুন কথা নয়, বাৎসায়নের যুগ থেকে কলকাতার বাবু সংস্কৃতির কালেও এটা সত্যি ছিল।
ইতিহাসের হিসাব অনুযায়ী বাৎসায়নের লেখালিখির কাল প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের ঘটনা। বাৎসায়ন লিখেছেন,কামদেবের পুজো করতে চৌষট্টি কলার জ্ঞান দরকার হয়।চৌষট্টি কলা মানে নাচ, গান, বাজনা তো আছেই সেই সঙ্গে তার মধ্যে পড়ে নানা ধরণের ছলাকলা থেকে শুরু করে জুয়া খেলার মতো বিষয়। আর এসব বিদ্যা শিক্ষার শুরু সরস্বতী পুজোর দিন। কারণ সরস্বতী হলেন এই সমস্ত বিদ্যার দেবী।
অন্যদিকে দেড়েশো বছর আগের কলকাতায় ফিরলেও মেলে সেই একই ছবি। সরস্বতী পুজো উপলক্ষে বাবুদের কলকাতার সোনাগাছি ,রামবাগান, হাড়কাটাগলির ঘরে ঘরে ফুর্তির ফোয়ারা বইতো। হুতোম যার বর্ননা দিয়েছেন তাঁর ‘সমাজ কুচিত্র নকশা’(১৮৬৫–র জানুয়ারি সংখ্যা)তে।
হুতোম তাঁর ‘সরস্বতী পূজা’ শীর্ষক নক্শায় লিখেছেন, ‘…আশ্বিন মাসের শারদীয় পঞ্চমীর মতো এ পঞ্চমীর তত মাহাত্ম্য নাই, তথাপি শহরে আমোদের স্রোত ধরচে না। ... বারঙ্গনা পল্লীর কথাই এক স্বতন্ত্র। সেখানে শহরের রকমারি আমোদের ও আমোদপ্রিয় দলের মানচিত্র অঙ্কিত হয়েচে। হিন্দুধর্ম যেন ইয়ং বেঙ্গলদের ভয়ে, ধুনো, শাঁখ, গঙ্গাজল ও পবিত্রতায় আচ্ছাদিত হয়ে ওই সকল কুঞ্জে লুকিয়ে রয়েচেন’।
তার মানে দেড়শো বছর আগে আজকের মতো স্কুল–কলেজগুলি সরস্বতী পুজোর যাবতীয় উৎসবের কেন্দ্রস্থল ছিল না। সরস্বতী পুজো মহা উৎসবে পরিণত হত কলকাতার নিষিদ্ধপ্ললিতে ‘উপপত্নীর বাড়িতে বাবুদের স্পনসর করা সরস্বতী পুজোয়।
সে পুজো দেখতে সাধারণ দর্শকের ভিড় প্রচুর। থাকতেন বাবুদের ইয়ার-দোস্তরাও, নিমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে’।
ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮২২ থেকে ১৮২৫- এই তিন বছরের মধ্যে কলকাতার নিষিদ্ধপল্লী নিয়ে ‘নববাবু বিলাস’, ‘নববিবি বিলাস’ এবং ‘দূতী বিলাস’ নামে তিনটে বই লিখেছিলেন। তাঁর তিনিটি বইতেই সরস্বতী বন্দনার উল্লেখ আছে।
এক শতাব্দী আগেও কলকাতার গণিকালয় অর্থাৎ যৌনকর্মীদের পাড়ায় যখন কলকাতার বাবুদের নিত্য যাতায়াত ছিল। তখন সেখানে সরস্বতী পুজো নিয়ে আগে থেকেই ধুমধাম শুরু হয়ে যেত। বাবুরা তখন সরস্বতী পুজোয় দরাজহস্ত হয়ে খরচ করতেন। সেই খরচ নিয়েও তৈরি হত প্রতিযোগিতা। যে বাবু সবথেকে বেশি খরচ করতে পারতেন তিনিই কিনতেন দাম। বিচারক হতেন বাবুদের বাড়ির চাকররা। দল বেঁধে সকলে মিলে পুজো দেখতে এলেও তথাকথিত ভদ্রলোকরা কিন্তু সেই পুজোকে সমর্থন করতেন না, এমনকি সেই পুজোয় পুরোহিতদেরও অনীহা ছিল।
তবে সরস্বতী যে নদী তাও মানতে হয়, কারণ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থেই সেকথা স্পষ্ট। সরস(জল)+মতুপ্+ঙীপ্ বা স্ত্রীলিঙ্গবাচক ‘ঈ’=সরস্বতী।
কারও মতে, সরস্বতী ব্রহ্মাবর্তের একটা ছোট্ট নদী,যেটি রাজস্থানের মরুভূমিতে হারিয়ে গিয়েছে। নদীকে বিদ্যার দেবী ভাবার কারণ নদীর পাড়ে ঋষিরা বেদ-উপনিষদ পাঠ করতেন। নদীর ধারেই হত কৃষিকাজ। তার মানে খাদ্য এবং বিদ্যা দুই নদী কেন্দ্রিক। সরসবতী নদী থেকে বিদ্যার মূর্তরূপ হয়ে দাঁড়াতেই পারে।
আবার ফিরে যাই নিষিদ্ধপল্লির সরস্বতী পুজোয়।‘সুলভ সমাচার’, ১৫ মাঘ, ১২৮০ ‘হিন্দু পর্বের মধ্যে কার্তিক ও সরস্বতী পূজার প্রতি বেশ্যাদিগের কিছু অধিক অনুরাগ দেখিতে পাওয়া যায়। সন্তান কামনা করিয়া লোকে কার্তিক পূজা করে এবং বিদ্যালাভের জন্য সরস্বতী পূজা করে। বেশ্যাদের পক্ষে এপ্রকার কামনা নিতান্ত অনধিকার চর্চা, তথাপি তাহারা কার্তিক ও সরস্বতী পূজায় খুব ধুমধাম করিয়া থাকে।’
ঋণঃএকাধিক লেখা