তাঁর অধিকাংশ রচনায় লেগে আছে মানুষের সুক্ষাতিসুক্ষ অনুভব, ছড়িয়ে আছে তাঁর অসাধারণ কৌতুকবোধ। মানুষটি মির্জা গালিব।একদিনগালিবের একবন্ধু জিঙ্গাসা করেন, দিল্লীতে ‘রথ’কে কোথাও স্ত্রী লিঙ্গ আবার কোথাও পুং লিঙ্গ বলে, মির্জা আপনি তো কবি, বলুন তো ‘রথ’ স্ত্রী লিঙ্গ না পুরুষ লিঙ্গ? গালিব তাঁর এক ‘শের’-এ তার জবাব দেন, জনাব রথে যখন নারী আরোহন করেন তখন স্ত্রী লিঙ্গ আর পুরুষ চড়লে পুং লিঙ্গ।
দিউয়ান ফজলুল্লাহ খাঁ ছিলেন মির্জা গালিবের বন্ধু ও ভক্ত। একদিন কোনও কাজে তার নিজের গাড়িতে চড়ে তাঁকে গালিবের বাড়ির পাশ দিয়েই যেতে আসতে হয়। সেদিন আর তিনি গালিবের সঙ্গে দেখা করেন না। এই ঘটনায় দুঃখ পেয়ে মির্জা তাঁকে চিঠি লিখে জানান-এর থেকে বেশি অনুতাপ আমার আর কি হতে পারে, আপনি আমার বাড়ির পাশ দিয়ে আসা যাওয়া করলেন, কিন্তু আমি ঘর থেকে বেরিয়ে আপনাকে একবারও সেলাম জানাতে পারলাম না। চিঠি পেয়ে ফজলুল্লাহ খাঁ এতটাই লজ্জিত হলেন যে তারপরই তিনি গালিবের বাড়িতে এসে হাজির হন।
আম ছিল খাদ্য রসিক গালিবের খুব প্রিয়। একবার গালিব বাহাদুর শাহ জাফরের বাগানে গিয়ে দেখেন বাদশা বাগানে পায়চারি করছেন আর বাদশাহী আম দেখছেন। সেই আম বাদশাহী মহল ছাড়া আর কারও খাওয়ার অধিকার নেই। মির্জা সেই আমের দিকে একমনে তাকিয়ে কিছু ভাবছিলেন। বাদশা সেটা খেয়াল করে জিগ্যেস করলেন ‘মির্জা, এত মন দিয়ে কি দেখছো? ’ মির্জা বললেন, শুনেছি এই আমে খাদকের এবং তার বাপ ঠাকুর্দার নাম লেখা থাকে। আমি দেখতে চাইছি কোন আমে আমার বাপ দাদার নাম লেখা আছে’। সমজদার মোগল বাদশা সেই দিনই এক টুকরি শাহী আম গালিবের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন।
গালিবের বন্ধু মির্জা সৈয়দ এক সন্ধ্যায় গালিবের বাড়িতে এসে আড্ডা ও পানাহার সেরে যখন বেরলেন তখন গালিব লন্ঠন নিয়ে ঘরের চৌকাঠ পর্যন্ত এলেন; যাতে লন্ঠনের আলোয় সৈয়দ জুতো পড়তে পারেন। সৈয়দ এতে সংকোচ বোধ করে বলেন, ‘আপনি আবার কষ্ট করে এগিয়ে এলেন কেন? আমি নিজেই জুতো পরে নিতে পারতাম’। গালিব মিষ্টি হেসে বললেন, ‘আরে আমি তো আপনার জুতো দেখানোর জন্যে লন্ঠন আনিনি। আমি দেখতে এসছি, আমার নতুন জুতো জোড়া যাতে আপনার সঙ্গে চলে না যায়’।
কেবলমাত্র কৌতুকবোধ নয়, গালিবের অহংকার বোধও ছিল সাধারণের থেকে বেশি। ১৮৪২ সালে দিল্লী কলেজ স্থাপিত হলে সেখানে ফারসি ভাষার অধ্যাপক পদে মির্জা গালিবকে নিয়োগ করা হয় একশো টাকামাসিক মাইনেতে। প্রথম দিন গালিব পালকিতে সচিবের অফিসের কাছে পৌঁছে লোক্মারফত তাঁর আগমন বার্তা পাঠান। সচিব খবর পেয়ে মির্জা গালিবকে ভিতরে আসতে বলেন। কিন্তু মির্জা পালকিতে বসেই অপেক্ষা করেন। কারণ প্রথা অনুযায়ী ভারত সচিব তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে আসবেন। তা না হলে তিনি পালকি থেকে নামবেন না।
শেষ পর্যন্ত সচিব বাইরে এলেন কিন্তু অর্ভ্যথনা না জানিয়ে বললেন, ‘মির্জা সাহেব, আপনি যখন গভর্নরের দরবারে আসবেন তখন আপনাকে অবশ্যই স্বাগত জানানো হবে। কিন্তু এখনতো আপনি চাকরি করতে এসেছেন তাই এখন সেটা সম্ভব নয়’। সে কথা শুনে গালিব মৃদু হেসে বললেন, সম্মান বেশি পাব বলে অধ্যাপক হয়েছি। সম্মান বিকিয়ে দিতে আসিনি’। সচিব বললেন, ‘আমি নিরুপায় মির্জা সাহেব, আপনাকে এই নিয়ম মানতে হবে। গালিব বললেন, ‘দুঃখিত সচিব সাহেব, আমিও চললাম। এইভাবে চাকরি করতে পারবো না’। এ কথা বলে গালিব ফিরে যান।