দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অকালে মারা গেলেন জর্জ ডেসমায়ার। তখন তাঁর স্ত্রী অন্ত্বঃসত্ত্বা। কিন্তু সেই অবস্থায় দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে রেঙ্গুন ছাড়তে হল তাঁকে। প্রথমে উদ্বাস্তু দলের সঙ্গে হাজার হাজার মাইল হেঁটে, কয়েকশো শহর-গ্রাম পেরিয়ে, অনাহার, অভাবী মা ধুঁকতে ধুঁকতে এসে পৌঁছলেন ডিব্রুগড়ে। সেখান থেকে ঠাঁই হল কলকাতায়। তারপর কলকাতার পাট চুকিয়ে মুম্বই।
ডেসমায়ার ও তাঁর স্ত্রী বড় মেয়ের নাম রেখেছিলেন হেলেন অ্যান রিচার্ডসন। তার পরে আরও একটি ছেলে রজার এবং একটি মেয়ে, জেনিফার। কলকাতায় রজারের মৃত্যু হয় গুটিবসন্তে, মুম্বাই আসার পর জেনিফারও বাঁচে না। আরবসাগরের তীরে মেয়ে হেলেনকে নিয়ে নতুন করে শুরু হল জীবনযুদ্ধ।
তখনওএই দেশ ব্রিটিশদের অধীন। নার্সের কাজ নিলেন মা। কিন্তু সেই কাজের বিনিময়ে যে সামান্য রোজগার তাতে নুন আনতেই পান্তা ফুরোয়। এদিকে মেয়েকে লেখাপড়া শেখাবেন বলে স্কুলে ভরতি করেছেন। মেয়ে মায়ের অবস্থা বুঝতে পেরে পাশে দাঁড়াতে চায়। একদিন তাই স্কুলে যাওয়া ছেড়ে দিল মেয়েটি। কাজ নিল বোম্বাইয়ের সিনেমা পাড়ায়। আরব সাগরের তীরে শুরু হল নতুন জীবনযুদ্ধ।

তালিম নিয়েছিলেন মণিপুরী, কত্থক এবং ভরতনাট্যমের মুনসিয়ানা দেখালেন তখনকার আপাত-নিষিদ্ধ ক্যাবারে নাচে। তাই নিয়েই পা রেখেছিলেন বলিউডে। কিন্তু বলার মতো প্রথম ব্রেক ১৯৫৮ সালে ‘হাওড়া ব্রিজ’ ছবিতে গীতা দত্তের গলায় ‘মেরা নাম চিন চিন চু’। উনিশ বছরের তন্বীর নাচ আইকনিক হয়ে গেল বলিউডে। হেলেন অ্যান রিচার্ডসন বলিউডে বিখ্যাত হয়ে গেলেন হেলেন নামে।‘ইন্তেকাম’-এর ‘আ জানে যাঁ’,ক্যারাভান-এর ‘পিয়া তু অব তো আ জা’, ‘শোলে’-এর ‘মেহবুবা ও মেহবুবা’ মনে হয় আজও বলিউডে গুঞ্জরণ তোলে।
তখনও বলিউডে মধুবালা কিম্বা বৈজয়ন্তিমালার দাপুটে উপস্থিতিকে এড়িয়ে যাওয়া কারও পক্ষেই সম্ভব ছিল না। তারপরওবলিউডের যে কোনও ছবিতে একটি গানের নাচে কিংবা ছোট্ট একটি চরিত্রে তিনি যে আবেদন রাখতেন তা অনেক সময়েই ওঁদের ভূমিকাকে ছাপিয়ে যেত। হেলেন কোনওদিনই নায়িকা হন নি, কিম্বা তাঁকে তেমন চরিত্রেও কেউ ভাবেন নি কখনও।তাঁর রুপোলি পর্দায় আগমন এবং প্রস্থান ঘটতো ভ্যাম্প বা খলনায়িকা কিংবা ক্যাবারে শিল্পী হিসেবেই।

গত শতকের তিরিশের দশকের বলিউডে যখন দেবিকা রানি, নিম্মি, কামিনী কৌশল, সুরাইয়ার মতো নায়িকারা প্রেমের কাহিনির চরিত্রাভিনেত্রী তখনও একজন খলনায়িকা খোলামেলা পোশাকে আবির্ভূত হতেন। পরবর্তীতেধরণটা বদলে যায় কিন্তু তখনও নায়ক নায়িকার প্রেমের মাঝখানে অনেক সময়ে খলনায়কের প্রতিনিধি হিসেবেও হাজির হতেন খলনায়িকা। সেখানেও থাকতো খোলামেলা পোষাকে নাচ ও গানের দৃশ্য। কিন্তু হেলেনের আবির্ভাবে যে আবেদন দৃশ্যে ফুটে উঠল তা বলিউডে একেবারেই ভিন্ন। খুব সামান্য সময়ের জন্যই তাঁর আসা এবং যাওয়া কিন্তু ওইটুকু ভূমিকাতেই তিনি দর্শক হৃদয় জয় করতেন। এবং আজও স্মরণে আছেন।

বলিউডের মেইনস্ট্রিম সিনেমার ঘটমান কাহিনিতেএক সময়ে নাচ ও গান দৃশ্য এসে পড়েই।যাকে পরিভাষায় আমরা রগরগে দৃশ্য বলতেই অভ্যস্ত কিন্তু সে দৃশ্য বেশিরভাগ দর্শকদের কাছে উপভোগ্য। সেই দৃশ্যে কখনো ছবির নায়িকা, অধিকাংশ ক্ষেত্রে খলনায়িকা কখনও আবার পার্শ্ব নারীচরিত্রছবিতে যৌনতার প্রতীক হয়ে ওঠেন নাচ ও গানের সেই দৃশ্যে। সত্তরের দশকে হেলেনের পাশাপাশি ছিলেন অনেকেই। কিন্তু তাঁরা সবাই পিছনে পরে থাকতেন। কারণ প্রতিটি ছবিতে হেলেনের আবির্ভাব ছিল নতুন নতুন চমক নিয়ে। গানের সঙ্গে হেলেনের অভিব্যক্তি ছিল আবেদনে ভরপুর। সুঅভিনেত্রী নায়িকা থেকে শুরু করে ড্রিম গার্ল হেমা মালিনী সৌন্দর্যের জন্য আলোচিত হলেও পর্দায় হেলেন তাঁর আবেদন দিয়ে তাক লাগিয়ে দিতেন। সেই আবেদন হল তার এনার্জেটিক পারফরমেন্স।
হেলেন অভিনয় ছেড়ে দিয়েছিলেন ১৯৮৩ সালে। তার বেশ কয়েক বছর পর তিনি ফের অভিনয় করেন ‘খামোশি দ্য মিউজিক্যাল’, ‘হাম দিল দে চুকে সনম’-এর মতো বক্স অফিস হিট সিনেমায়। বলিউডে আইটেম নম্বরে পথ প্রদর্শক, ক্যাবারে কুইন হেলেন আজ ৮৪ বছরে পা রাখলেন।
1 Comment
খোলামেলা পোশাকে অনেকেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হতে চান কিন্তু পারফরমেন্স ছাড়া সেই আলোচনাটা খুব তাড়াতাড়ি উবে যায়।