মাথা নেই এমন ভূতের কথা তেমন নতুন নয়, এদের কথা আমরা আগেই শুনেছি। স্কন্ধকাটা নামের এই ভূতেদের কোনো মাথা থাকে না। রামায়ণে ‘কবন্ধ’ নামের পিশাচ-এর কথা আছে, তারাও মাথাবিহীন। কেবল তাই নয়, তাদের একটি চোখ ছিল পেটের ভেতর; আর ছিল বিশাল বাহুসমেত হাত। শোনা যায় চীনা দেবতা জিংশিয়ানেরও কোনো মাথা নেই। তার বদলে নাভির জায়গায় আছে মুখ আর দুটি স্তনের দুটি বৃন্তের জায়গায় দুটি চোখ! হুয়াংডির যুদ্ধে শিরশ্ছেদের শিকার হয়ে তার এই পরিণত হয়।তবে এরা সবই পৌরাণিক চরিত্র। কিন্তু যদি বলা হয়, বাস্তবেও দেখা গিয়েছে এমন মুণ্ডছাড়া জীবদের- তাও আবার মানুষ! সবাই বলবেন, এমন আবার হয় নাকি, এসব কথা নিছক বানানো গল্প ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে বলা হয় যে ‘ব্লেমিস’ হ্যাঁ তারা এই নামেই পরিচিত, তারা মানুষ হলেও চিল মাথাবিহীন- প্রাচীন বিভিন্ন লেখা এমনটাই বলছে।

‘ব্লেমিস’ শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায় ‘জিওগ্রাফি অব স্ট্রাবো’-তে। প্রথম শতাব্দীর গ্রিক দার্শনিক স্ট্রাবোও তাদের কথা উল্লেখ করেছেন। না, তারাও কোনো দানব নয়, মানুষ। স্ট্রাবোর মতে, তারা ছিল একটি আদিবাসী গোত্র- যাদের বসবাস ছিল নুবিয়ার নিম্নভূমিতে। এই জায়গাটি পড়েছে ইথিওপিয়ায়। শুধু সেখানেই নয়, নীল নদ হয়ে তাদের বসতি বিস্তার লাভ করেছিল লোহিত সাগর পর্যন্ত। গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাসের লেখাতেও এসেছে মাথাবিহীন মানুষদের কথা। তাদের কারও কারও চোখ থাকত বাহুতে, আবার কারও কারও ক্ষেত্রে সেটি বুকে বা পেটের মধ্যে। হেরোডোটাসের এই অদ্ভুত মানুষদের কথা স্ট্রাবোর বর্ণনায় পাওয়া যায়। রোমান লেখক ও ইতিহাসবিদ প্লিনি দ্য এলডার এদের একই গোষ্ঠী বলে মত দেন। প্লিনি তাঁর ‘ন্যাচারাল হিস্ট্রি’ নামে বইয়ে তাদের বিশদ বিবরণ দিয়েছেন। তাঁর মতে, ‘ব্লেমিসদের কোনো মাথা থাকত না, তাদের মুখ আর চোখগুলি থাকতো তাদের বুকে!’ তবে প্লিনি কিংবা হেরোডোটাস- কেউই নিজের চোখে এদের দেখেননি। তাদের বর্ণনার সূত্র হল- শোনা কথা বা লোকমুখে প্রচলিত গল্পগাথা। এছাড়া দার্শনিক সোলিনাসের বর্ণনাতেও লোকমুখে শোনা এই ধরনের মাথাবিহীন জীবদের কথা এসেছে।

তবে ব্লেমিস অথবা মাথাবিহীন জীবদের নিয়ে প্লিনি কিংবা হেরোডোটাসের বর্ণনার থেকেও চমকপ্রদ একটি ব্যাপার হল সেনাপতি মার্কাস অরেলিয়াসের বাহিনীর বিরুদ্ধে ‘পালমিরার যুদ্ধে’ ব্লেমিসদের লড়াই। এমন কথাও প্রচলিত আছে, থেবাইস দ্বীপটি ছিল ব্লেমিসদের নিয়ন্ত্রণে। তাদের থেকে দ্বীপটি অধিকার করে নেওয়ার জন্যেই অরেলিয়াস তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন ও ব্লেমিসদের বাহিনী কার্যত পরাজয় বরণ করে।তবে এরা খিষ্টপূর্ব যুগের মানুষ কিংবা খ্রিষ্ট্রীয় প্রথম-দ্বিতীয় শতাব্দীর। মধ্যযুগ কিংবা তারপরও কিন্তু কারও কারও বর্ণনায় এসেছে এদের কথা। চতুর্দশ শতাব্দীর পর্যটক স্যার জন ম্যানডেভিল-এর ‘দ্য ট্রাভেলস অব স্যার জন ম্যানডেভিল’-এও ব্লেমিস কিংবা মাথাবিহীন জীবদের উল্লেখ আছে। ম্যানডেভিল কিন্তু এদের উল্লেখ করেন- ‘লোকমুখে শোনা, উদ্ভট গড়নের জীব’ বলে। তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী, এরা মাথাবিহীন, এদের চোখ থাকতো কাঁধে। তবে ম্যানডেভিলের বর্ণিত এই ব্লেমিসরা কিন্তু আফ্রিকার নয়। তিনি এদের থাকার জায়গা হিসেবে বলেছেন এশিয়ার প্রত্যন্ত কিছু দ্বীপের কথা।

ষোড়শ- সপ্তদশ শতকের অভিযাত্রী স্যার ওয়াল্টার র্যালেই-এর বর্ণণাতেও এমন অদ্ভুত এক প্রাণীর কথা পাওয়া যায়, যেটির সঙ্গে মাথাবিহীন এই ব্লেমিসদের বেশ সাদৃশ্য আছে। তিনি এদের নাম উল্লেখ করেন- ‘এয়াইপানোমা’। এদের মাথা নেই। চোখ থাকে কাঁধে, আর ২ স্তনের মাঝের জায়গায় থাকে মুখ। তাদের মাথার পেছনে দু’দিকের ঘাড় বেয়ে নেমে আসে দীঘ চুল। তবে র্যালেই এদের বসবাস নিয়ে জানান দক্ষিণ আমেরিকার গায়ানা দ্বীপপুঞ্জের কথা। ‘ডিস্কোভারি অব গায়ানায়’ তিনি উল্লেখ করেন, এদের বসতি ছিলো কাউরা নদীর তীরে। তিনিও কখনো এদের নিজের চোখে দেখেননি, তবে তিনি যে পরিমাণ মানুষদের এর অস্তিত্বের পক্ষে সাক্ষ্য দিতে শোনেন, তাতে তাঁর মনে হয়েছিল এদের অস্তিত্ব অবশ্যই আছে! অ্যারোমায়া ও কানুরি প্রদেশগুলোর শিশুরা পর্যন্ত বলতো তাদের দেখতে পাওয়ার কথা!

তবে সমসাময়িক ইতিহাসবিদ জোয়ানেস দ্য লায়েট এই ধরনের মানুষদের অস্তিত্বকে গালগল্প বলেই উড়িয়ে দেন। তিনি মনে করতেন, হয়ত এমন কোনো গোষ্ঠী আছে যাদের গলা খুব ছোট অথবা শরীর বিশাল আকৃতির হলেও মাথা সেই তুলনায় ছোট। এই কারণে দূর থেকে দেখলে মনে হয় মাথাবিহীন মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে। পরবর্তীকালে কোনো পর্যটকের লেখায় এদের স্পষ্টভাবে দেখা গিয়েছে এমন প্রমাণ মেলেনি। কাজেই ব্লেমিস বা মাথাবিহীন মানুষদের অস্তিত্বের ব্যাপারটি কোনো প্রামাণ্য সত্য নয়। বরং, এটিকে প্রচলিত লোকজ গল্পগাথা বা সর্বোচ্চ লোকজ কিংবদন্তী হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায়।