ডাক্তারবাবুরা যে কোনো ধরনের ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া থেকে রেহাই পেতে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার কথা বলেন। কিন্তু একদিন এই হাত ধোয়ার কথা বলায় তাঁকে পাগল অভিহিত হতে হয়েছিল, চাকরি হারিয়ে শেষ পর্যন্ত তাকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত তাঁকে মরতেও হয়েছিল। তিনি ইগনাজ ফিলিপ সেমলভাইস, মেডিক্যাল সার্জারিতে অ্যান্টিসেপ্টিক পদ্ধতি অনুসরণের পথিকৃৎ। দেড় দুশো বছর আগে ইউরোপে সন্তান জন্মদানের অবস্থা খুব একটা সুবিধাজনক ছিল না। সেখানকার চাইল্ড কেয়ার ক্লিনিকগুলোতে প্রায়ই Puerperal Fever জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মা ও শিশুর মৃত্যু ঘটত। যাকে চাইল্ডবেড ফিভার বলা হত। সেই আমলে যদি বাড়িতে ধাত্রীর হাতে সন্তান প্রসব হত তবে হাজারে ৫ জন মা মারা যেতেন কিন্তু অবাক হলেও হাসপাতালে মৃত্যুর হার ছিলো প্রায় ১০-১৫ গুণ!

ইগনাজ সেমলভাইস অস্ট্রিয়ার ভিয়েনার এক জেনারেল হাসপাতালে প্রসূতি সেবা বিভাগে তাঁর অধীনের দুটি ওয়ার্ডে ( প্রফেশনাল ডাক্তার ও ধাত্রীবিদ্যা জানা) খেয়াল করলেন, প্রথম ওয়ার্ডে রোগীদের চাইল্ডবেড ফিভারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুহার ১০ শতাংশ আর দ্বিতীয় ওয়ার্ডে ৪ শতাংশ। যে ওয়ার্ডে প্রফেশনাল ডাক্তারেরা সেবা দিতেন, সেখানে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুহার ছিলো দুস্থ-গরীবদের জন্যে খোলা ওয়ার্ডের মৃত্যুহারের চেয়ে বেশি। সাধারণ ধাত্রীদের হাতে অনেক বেশিসংখ্যক শিশু সুস্থ শরীরে জন্ম নিয়ে মায়ের কোলে বাড়ি ফিরে যেত। এমন পরিস্থিতে অনেকেই প্রফেশনাল ডাক্তারদের ওয়ার্ডে ভর্তি না হয়ে দ্বিতীয় ওয়ার্ডে ভর্তি হতে চাইতেন। ডিপার্টমেন্টের দায়িত্ব পেয়েই কাজ শুরু করলেন সেমলভাইস। দুই ওয়ার্ডকে পর্যবেক্ষণে রাখা শুরু করলেন। দুই ওয়ার্ডে যেসব বিষয়ে পার্থক্য আছে, সেগুলো নোট করলেন। শুরুতেই সেমলভাইস জনসমাগম বাদ দিলেন। কারণ দ্বিতীয় ওয়ার্ডে মানুষ বেশি ভর্তি হতে চাইতো। তাতে রোগীর সংখ্যা ছিল খুব বেশি। কিন্তু মৃত্যুহার ছিল কম।

কিছুদিন পর তিনি দেখলেন, ডাক্তারেরা প্রথম ওয়ার্ডে মায়েদের পিঠের ওপরে ভর দিয়ে শুইয়ে সন্তান প্রসব করাচ্ছেন আর দ্বিতীয় ওয়ার্ডে ধাত্রীরা মায়েদের পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে সন্তান প্রসব করাচ্ছেন। এটাই কি কারণ? তাই সেমলভাইস নির্দেশ দিলেন প্রথম ওয়ার্ডেও মা-দের পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে সন্তান প্রসব করাতে। তাতেও ফল পাওয়া গেলো শূন্য। চাইল্ডবেড ফিভারে মৃত্যুহার সেই একই। কিছুদিন পর আর একটি বিষয় নজরে পড়লো সেমলভাইসের। যখন কোনো রোগী চাইল্ডবেড ফিভারে মারা যেতেন, তখন হাসপাতালের চার্চের একজন যাজক সেই রোগীর বেডের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতেন। তার পেছনে পেছনে একজন অ্যাটেনডেন্ট হাতে ঘণ্টা বাজাতেনে আর হাঁটতেন। সেমলভাইস ভাবলেন, যাজককে দেখে এবং তার ঘণ্টার শব্দ শুনে রোগীরা কি আচমকা ভয় পেয়ে ওঠেন, যাতে জ্বর চলে আসে আর রোগী মারা যায়? এসব ভেবে তিনি যাজককে রোগী মারা গেলে অন্য পথ ধরে হাঁটার অনুরোধ করলেন। কিন্তু তাতেও ফলাফল শূন্য। এবার এক প্যাথলজিস্ট সহকর্মী অসুস্থ হয়ে মারা গেলেন। সেই সময়ে প্যাথলজিস্টদের জ্বরের ফলে মৃত্যু একটু বেশিই হত। সেমলভাইস খবর পেলেন ওই কলিগের লাশ অটোপসি করার সময়ে আঙ্গুলে সুঁচের খোঁচা খেয়েছিলেন। এরপরে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মারা যান। সেমলভাইস জ্বরের লক্ষণগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখলেন, হাসপাতালের গর্ভবতী মায়েদের মতো তার কলিগও ঠিক একই জ্বরে মারা গেছেন।

সেমলভাইস শেষ পর্যন্ত উদঘাটন করলেন প্রথম ওয়ার্ডের ডাক্তারেরা প্রায়ই লাশের অটোপসি করেন, যেটা দ্বিতীয় ওয়ার্ডের ধাত্রীদের করতে হয় না। তার মানে লাশের শরীরে এমন কিছু বিষাক্ত পদার্থ থাকতে পারে, যেগুলো অটোপসি করা ডাক্তারদের হাতে করে চলে যাচ্ছে মায়েদের শরীরের ভেতরে। পরে শরীরে বিষক্রিয়ায় পর মৃত্যু হচ্ছে। এরপরই নির্দেশ দিলেন, ডাক্তারেরা যাতে ক্লোরিন দিয়ে হাত ও সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি ধুয়ে তারপরে মায়েদের সন্তান প্রসব করান। জীবাণুনাশক ক্লোরিনের ব্যবহার শুরুর পরেই নাটকীয়ভাবে প্রথম ওয়ার্ডে রোগীদের মৃত্যুহার কমে যায়। কিন্তু যে ডাক্তার জীবন বাঁচান তিনিই রোগ ছড়িয়ে রোগীদের মারছেন, এমনটাই প্রচার হওয়ায় তীব্র প্রতিরোধ শুরু হল। চার্লস ডেলুসেনা মেইগস নামের এক ডাক্তার ঘোষণা করলেন, কোনো ডাক্তার হাত ধোবে না। অন্য ডাক্তাররাও সমর্থন জানিয়ে হাত না ধুয়েই তারা প্রসূতিদের সেবা দিতে লাগলেন। তীব্র বিরোধিতার মুখে ডাক্তার সেমলভাইসের চাকরি গেলে তিনি ভিয়েনা ছেড়ে চলে গেলেন বুদাপেস্টে। শেষ পর্যন্ত ‘যেইন্ট রোকুস’ হাসপাতালে বিনা বেতনে হেড ফিজিশিয়ানের দায়িত্ব নেন। সেখানেও চাইল্ডবেড ফিভারের সমস্যা। সেমলভাইসের ক্লোরিন দিয়ে হাত ধোয়ার থেরাপিতে আশাতীত ফলাফল পাওয়া যায়। সেখানেও মায়েদের মৃত্যুহার হ্রাস পায়। তার কাজের রিপোর্ট ওপর মহলেগেলে তারা যথারীতি হেসে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেন সেসব রিপোর্ট। ডাক্তার সমাজে হাসির পাত্র হয়ে উঠেন সেমলভাইস।

এই বৈপ্লবিক আবিষ্কারের মাত্র এক যুগের মাথায় সেমলভাইস পুরো হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। তাঁকে ভিয়েনার এক মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেই হাসপাতালের প্রধান ডাক্তার ফার্দিনান্দ রিটার ভন হেবরা এসে সেমলভাইসের সাথে পরিচিত হয়ে তাকে ভিয়েনার মানসিক হাসপাতালটা ঘুরে দেখার আমন্ত্রণ জানান, কিন্তু তিনি উপস্থিত হলে তাঁকে আটকে দিয়ে শুরু হয় পাগলের চিকিৎসা, হাত-পা বেঁধে শক্ত করে মারা হয়। এর দু’সপ্তাহ পর মারা যান সেমলভাইস। তবে কয়েক দশক পরে, তাঁর ধারণাগুলি ‘জীবাণু তত্ত্ব’ অবদানের জন্য কৃতিত্ব পেয়েছিল।