দুটি আরবি শব্দ ‘হাল’ আর ‘খাতা’, হাল মানে চলতি এবং খাতা-র অর্থ হিসাবের বই। অবিভক্ত ভারতবর্ষে মুসলিম শাসন আমলেই এই শব্দদুটি বাঙালির ধারাবাহিক জীবনপ্রবাহে মিশে তৈরি হয়েছিল হালখাতা। অতীতে হালখাতা ছিল বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব। বিষয়টি ছিল পুরোপুরি একটি অর্থনৈতিক ব্যাপার। বৈশাখের প্রথম দিন গ্রামবাংলা, মফস্বল বা শহরে, ছোট-মাঝারি-বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হালখাতার আয়োজন করা হত। পুরোনো হিসাবের খাতা বন্ধ ও নতুন হিসাবের খাতা খোলার যে আয়োজন, তার আপ্যায়ন ও আনুষ্ঠানিকতার নাম হালখাতা। সেই উপলক্ষে ছাপানো হত নিমন্ত্রণপত্র, চলত নানা আয়োজন। উৎসব-উদ্দীপনার মধ্যে অনুষ্ঠিত হত হালখাতা উৎসব। এই উপলক্ষে ব্যবসায়ীরা নতুন-পুরোনো খদ্দেরদের আমন্ত্রণ জানিয়ে ক্রেতাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগসূত্র ঝালিয়ে নিতেন। ফল, মিষ্টি বিতরণ করতেন।

তবে গ্রামের হালখাতা আর শহরের হালখাতার মধ্যে ফারাক থাকতো। গ্রামের হালখাতাতে ব্যবসায়ীরা বৈশাখের প্রথম দিন সকালে এসে দোকান পরিষ্কার করে কাগজের ফুল দিয়ে দোকানঘর সাজাতেন। দোকানের সামনেই কারিগরকে দিয়ে তৈরি করা হত মিষ্টান্ন আর তাই দিয়েই খদ্দেরকে আপ্যায়ন করা হত। কেউ আবার খদ্দেরকে আপ্যায়ন করত দই-চিড়া-মিষ্টি দিয়ে। শহরের ব্যবসায়ীরা হালখাতার দিনে দোকান সাজাত নানা রঙের আলো দিয়ে। চিরাচরিত এই অনুষ্ঠানটি আজও বহু দোকানে পালিত হয়। এটি বাংলা নববর্ষ সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলা সনের প্রথম দিন দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করা একটা আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনে ব্যবসায়ীরা তাদের দেনা-পাওনার হিসাব একত্রিত করে একটি মোটা লাল খাতায়, যা টালিখাতা বা খেরোখাতা নামেও পরিচিত সেই খাতায় লিখে রাখতেন।

হিসাবের খাতা হালনাগাদ করা থেকে হালখাতার উদ্ভব। এইদিন খদ্দেরদের বিনীতভাবে পাওনা শোধ করার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। এই উপলক্ষে নববর্ষের দিন ব্যবসায়ীরা তাদের খদ্দেরদের আমন্ত্রণপত্র পাঠান। আগে হালখাতা উৎসব অন্য রকম একটা আনন্দ ছিল। যে যার সাধ্যমতো কার্ড ছাপানো আর কার্ডে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা লিখতেন ‘এলাহী ভরসা’ আর হিন্দুরা তাদের কার্ডের ওপর লিখতেন ‘শ্রী শ্রী সিদ্ধিদাতা গণেশায় নমঃ’। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কিছুকাল আগেও হাল-ফ্যাশনের কার্ড ছিল। ঐতিহ্যের এই আয়োজন ধরে রাখতে ক্রেতার আগ্রহে প্রতিবছর সাড়া দিতে উন্মুখ থাকেন বিক্রেতারাও। হালখাতার এই আয়োজন হত পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ছোট-বড়, মাঝারি যেকোনো দোকানেই। পয়লা বৈশাখের সকালে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা দোকানি ও ব্যবসায়ীরা সিদ্ধিদাতা গণেশ ও বিত্তের দেবী লক্ষ্মীর পুজো করে থাকেন এই কামনায় যে, সারা বছর যেন তাদের ব্যবসা ভালো যায়। তারা গণেশ পুজো দিয়ে হালখাতার মাধ্যমে লেনদেন শুরু করেন। দেবতার পূজা অর্চনার পর তার পায়ে ছোঁয়ানো সিঁদুর ও চন্দন চর্চিত খাতায় আরম্ভ হয় নতুন বছরের হিসাব-নিকাশ। অক্ষয় তৃতীয়ার দিনেও হালখাতা বা শুভ মহরত অনুষ্ঠান করে থাকেন অনেক ব্যবসায়ী। এই দিনে মুসলিম ব্যবসায়ীরা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে মিলাদ মাহফিল ও গোলাপজল ছিটিয়ে শুরু করেন বছরের প্রথম দিনের কাজ।

ব্যবসায়ীরা হালখাতার নিমন্ত্রণপত্র ক্রেতা বা ব্যবসায়ীর বাড়িতে পাঠান। ‘শুভ নববর্ষ’ বা ‘শুভ হালখাতা’ লেখা ব্যানার ঝুলিয়ে দেন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সামনে। ক্রেতাদের আনন্দদানের জন্য মিষ্টান্ন, লুচি, মৌসুমী ফল ও ঠান্ডা পানীয় প্রভৃতির ব্যবস্থা করেন। বিক্রেতারা যখন মেজবানের ভূমিকায় তখন ক্রেতারা আসেন অতিথি বেশে। দেনা শোধ, মিষ্টিমুখ পাশাপাশি থাকে বিভিন্ন উপহারও। তবে আধুনিক সময়ের পাওনা পরিশোধে নতুনত্ব থাকলেও হাজার বছরের ঐতিহ্য হালখাতার চল ধরে রাখার চেষ্টা চলছে এখনও। তবে বাস্তবতা হল, আগের মতো সেই জৌলুস নেই এই হালখাতা উৎসবে। অনেকেই হালখাতা করে আসছেন কেবল নিয়ম রক্ষার জন্য। কারণ বর্তমানে চাকরিজীবী থেকে শুরু করে ব্যবসায়ীরা প্রায় সবাই ইংরেজি বর্ষপঞ্জির ওপর ভিত্তি করে আয়-ব্যয় করেন। নগদ বিক্রি অথবা বাকি লেনদেন সবই হয় ওই মাসের ওপর ভিত্তি করে। তাই ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে হালখাতার প্রথা। অন্যদিকে সবাই যখন একই দিনে হালখাতার তারিখ নির্ধারণ করেন তখন সব বকেয়া আদায় হয় না বলেই মনে করেন ব্যবসায়ীরা। কারণ হিসেবে তারা দেখান, একই খদ্দেরের একাধিক দোকানে বাকি থাকতে পারে। তাই পয়লা বৈশাখে অনেকেই এখন আর হালখাতা করে না।

আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে অনেক প্রতিষ্ঠানে হালখাতার রীতি বা আমেজ এখন আর তেমন নেই। হিসাব রাখার জন্য ব্যবহৃত লাল মোড়কের বিশেষ খাতার পরিবর্তে এখন হিসাব সংরক্ষণ করেন কম্পিউটারে। ফলে কালের বিবর্তনে, কালের গর্ভে হারাচ্ছে বাঙালির প্রাণের এই উৎসব। আধুনিক যুগের অনলাইন ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তির পৃথিবীর কাছে টিকতে পারছে না এই সনাতন রীতি। ফলে হালখাতার দিনে পুরোনো খাতা বাদ দিয়ে নতুন খাতার যে আবেদন, তা অনেকাংশে কমে গেছে। ব্যবসায়ীরাও মনে করেন, ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে আগে যে হৃদ্যতা ছিল, এখনকার সময়ে তা অনেকটাই ম্লান হয়ে যাচ্ছে। তবুও হাজারো প্রতিকূলতার মধ্যেও কোনো কোনো ব্যবসায়ী হালখাতার ঐতিহ্যটুকু ধরে রেখেছেন নিজেদের সাধ্য সামর্থ্যরে মধ্যেও। এখনো মিষ্টিমুখে শুরু হয় বছরের শুরুর দিনটিতে।
