এক নজরে

জরুরি অবস্থায় মুক্তি পাওয়া ‘শোলে’তে রামগড়বাসীর মুখ বন্ধ রেখেছিল গব্বর  

By admin

March 28, 2025

পঞ্চাশে পা রাখলো ‘শোলে’। মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। সেই সময়ে মাল্টিস্টার ছবিটির বাজেট ছিল তিন কোটি টাকা। কিন্তু প্রথম সপ্তাহে টিকিট বিক্রি বাবদ আয় মাত্র ৬৯ লক্ষ টাকা। টিকিট বিক্রির ওই হাল দেখেই ধরে নেওয়া হয় যে ছবি ফ্লপ। প্রোজজক থেকে পরিচালক সকলেই হতাশ দৃষ্টিতে যেন বললেন, তাহলে কি সব আশা অঙ্কুরেই মাঠে মারা গেল? অন্যদিকে কয়েকটি প্রোডাকশন হাউস তো ‘শোলে’ ফ্লপ করার আনন্দে পার্টি দিয়ে ফেললো, যেখানে প্রযোজক, পরিবেশকেরা আওয়াজ দিলেন, ‘ফালতু মাল্টি স্টারার নিয়ে হাইপ তোলার চেষ্টা, এখন দ্যাখ কেমন লাগে!’ ইতিমধ্যে সাতদিন পেরনোর আগেই একটি সংবাদপত্রের সিনেমা পাতার সমালোচনায় টুকরো টুকরো করে ‘শোলে’কে যেভাবে কাটা ছেঁড়া করা হয়, তাতে ছবিটিকে টুকলি বলা হয়েছিল, তারপর ছবির চিত্রনাট্য, একগাদা অভিনেতা, অভিনেত্রী নির্বাচনকেও শ্লেষাত্মক বা ব্যাঙ্গাত্মক ভাষায় সমালোচনা করলো, ফলে মুম্বাইয়ের সিনে দুনিয়ায় বিদ্ধ হল ‘শোলে’। বোঝা গেল বাঁচার আর কোনো পথ নেই।  

কিন্তু হাল ছাড়তে রাজি হলেন না রমেশ সিপ্পি, জি পি সিপ্পি, সেলিম খান, জাভেদ আখতার প্রমুখ। তাদের প্রশ্ন কোনোভাবেই কি এই ছবিকে বাঁচানো সম্ভব নয়? রাস্তা খুঁজে বের করতেই জাভেদ আখতারের বাড়িতে বৈঠকে বসলেন পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার। ‘শোলে’র পরিচালক রমেশ সিপ্পি জানালেন, তাঁর মনে হয় ছবি মার খেয়েছে কয়েকটি দৃশ্যের জন্য। তখনও ছবিটি সব জায়গায় রিলিজ করেনি, তাই তিনি মনে করেন, কয়েকটি দৃশ্য নতুন করে তুলে বাদ বাকি জায়গায় রিলিজ করানো হলে কিছু পয়সা উঠে আসতে পারে। রমেশের কথা শুনে বেশ জোরেই মাথা নাড়লেন ছবির চিত্রনাট্যকার সেলিম ও জাভেদ। দু’জনেই জোরের সঙ্গে বললেন, ‘ভারতীয় চলচ্চিত্রে ‘শোলে’ একটি নতুন ঘরানার ছবি, এই ছবি হিট করবেই’। তাঁদের মনে হয়েছিল, ছবির প্রচারে কোনও খামতি আছে। সেদিনের আলোচনার পর মুম্বাইয়ের দু’টি দৈনিকে ‘শোলে’র ফুল পেজ বিজ্ঞাপন দেওয়া হল। পরবর্তী দু-তিনটি সপ্তাহে লক্ষ্য করা গেল, ‘শোলে’র টিকিট বিক্রি একটু একটু করে বাড়ছে। এরপর ‘শোলে’ দেশের অন্য প্রদেশেও রিলিজ করতে লাগল। দর্শকদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়তে লাগল ‘শোলে’র আলোচনা।

মাউথ পাবলিসিটি হওয়ার পর থেকেই ‘শোলে’র টিকিট বিক্রি হু হু করে বাড়তে শুরু করলো। নবম সপ্তাহে পৌঁছে দেখা গেল ‘শোলে’ ব্যবসা করেছে ৫৯ লক্ষ টাকা। দশম সপ্তাহে ‘শোলে’ দেখার জন্য বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে দর্শক ঝাপিয়ে পড়লো, টিকিটের জন্য হাহাকার শুরু হল। দু’টাকার টিকিট ব্ল্যাক হল পাঁচ-ছ’টাকায়। দশম সপ্তাহে শোলে ব্যবসা করল ৯ কোটি টাকা। এরপর আর ফ্লপ ‘শোলে’ পিছনের দিকে তাকানোর অবকাশ পায়নি। কেবল ব্যবসা নয়, ‘শোলে’র জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়লো গোটা দেশে। পঞ্চাশ বছরে পা দেওয়ার অনেক আগেই ‘শোলে’ মিথে পরিণত হয়েছিল। ব্যবসার দিক থেকে অন্য অনেক ছবি ‘শোলে’কে টপকে গিয়েছে ঠিকই কিন্তু ৫০ বছর ধরে রাজত্ব করার ক্ষমতা দেখিয়েছে একমাত্র ‘শোলে’। জনপ্রিয়তার নিরিখে গত পাঁচ দশকের ভারতীয় সিনেমা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে এমন জনপ্রিয়, সুপারহিট, বাণিজ্যিক সফল ছবি আমাদের দেশে খুব কমই তৈরি হয়েছে। সেই বিনোদন যেন সর্বজনীন ও সর্বকালীন হয়ে আছে। ‘শোলে’ যে সময় রিলিজ করেছিল, সেই সময় কেবল বদলায় নি, পালটে গিয়েছে সময়ের প্রাসঙ্গিকতা ও প্রেক্ষাপট, কিন্তু বদলায়নি ‘শোলে’র বিনোদনের মাত্রাহীন আবেদন।

‘শোলে’র মধ্যে যে ভরপুর বিনোদন আছে সেই বিনোদন স্রেফ পাঁচমিশেলি মশলা নয়, আছে একধরনের বদলা, চ্যালেঞ্জ, অবশ্য হিংসাও আছে। তবে সেসব বিন্যাস ছাপিয়েও আছে দুই বন্ধুর বন্ধুতা। ‘শোলে’ যখন মুক্তি পেয়েছিল তার আগে সারাদেশে জরুরি অবস্থা ঘোষিত হয়েছিল। দেশের মানুষের বাক-স্বাধীনতা তখনও রুদ্ধ, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কথা বলা তখন নিষিদ্ধ। অন্যদিকে ‘শোলে’র প্রেক্ষাপটের রামগড়ে গব্বর সিংয়ের অত্যাচার, উৎপীড়ন মানুষের জীবনকে অতিষ্ট করে তুললেও, তারা ছিল অসহায়। তারা কেবল আতঙ্ক, উৎকণ্ঠার জীবন কাটাচ্ছিল না, গব্বর কেড়ে নিয়েছিল রামগড়ের মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং বাক স্বাধীনতা। সেইসব অসহায় মানুষের একমাত্র প্রতীক ঠাকুরসাব-এরও দুটো হাতও কেটে নিয়েছিল গব্বর, অর্থাৎ গণতন্ত্রকে পঙ্গু করে দেওয়া, সাধারণ জীবনে ত্রাস সৃষ্টি করা। এই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্যই ঠাকুরসাব জয় এবং বীরুকে (অর্থাৎ বীরত্ব এবং জয়, যেখানে বীরত্ব জয় সেখানে অনিবার্য) রামগড়ে এনেছিল বদলা নিতে। বদলা অবশ্যই হিংসার এবং তার ব্যবহারও ঘটে ব্যাপকভাবে দু’টি শক্তি বা শিবিরের মধ্যে। একটি ঠাকুরসাবের শিবির, অন্যটি গব্বর সিংদের শিবির। হিংসা-যুদ্ধের মধ্য দিয়েই ‘শোলে’তে অশুভ শক্তির বিনাশ এবং সত্যের প্রতিষ্ঠা হয়।

একটি সুপারহিট ছবি তৈরি করতে সেলিম ও জাভেদ যে আকিরা কুরোসাওয়ার ‘সেভেন সামুরাই’-এর আখ্যানটিকে সামনে রেখেছিলেন তা বলতে দ্বিধা নেই। প্রায় সাত দশক আগে তৈরি ওই জাপানি ছবিটি যে সারা বিশ্বে আলোড়ন ফেলেছিল তা কেবলমাত্র আকিরা কুরোসাওয়ার চলচ্চিত্র নির্মানের কারণে নয়, ছবির ঘটনাবহুল আখ্যানের জন্যেই। গ্রামবাসীদের ফসল লুট করে নিয়ে পালায় দস্যুরা। কিন্তু গ্রামবাসীরা প্রতিরোধ গরে তুলতে অক্ষম। তাই সাতজন সামুরাই বা যোদ্ধাকে তারা ভাড়া করে নিয়ে আসে বদলা নেওয়ার জন্য। এই ছবির অনুসরণেই হলিউডে ‘ম্যাগনিফিসেন্ট সেভেন’ থেকে শুরুই করে ‘দ্য ডার্টি  ডজন’, ‘দ্য স্যাভেজ সেভেন’ ছাড়াও একাধিক ছবি তৈরি হয়েছে, পাশাপাশি ‘সাত হিন্দুস্তানি’, ‘খোটে সিক্কে’, ‘হুকুমত’, ‘তহলকা’, ‘কিমত’, ‘চায়না গেট’ ইত্যাদি একাধিক বলিউডি ছবিও হয়েছে। কিন্তু সুপার ডুপারহিট ছবিটির নাম হল ‘শোলে’।