হলি গ্রেইল আসলে কি তা আজ পর্যন্ত কেউ স্পষ্ট করে বলতে পারেনি। তবে ধারণা করা হয়, হলি গ্রেইল হল সেই পানপাত্র যেটি দিয়ে যিশু মৃত্যুর আগে শেষ ভোজ করেছিলেন। হলি গ্রেইল নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে, সিনেমা তৈরি হয়েছে, কল্পকাহিনীও রচিত হয়েছে। হলি গ্রেইলকে যীশুর শেষ পানপাত্র বলা হলেও অনেকে দাবি করে হলি গ্রেইল কোনো পানপাত্র নয়, এটি একটি কোড যেটি কিনা ম্যারি ম্যাগদালেন নামক একজন নারী। জানা যায়, হলি গ্রেইল রক্ষা করার জন্য অনেকগুলি গুপ্ত সংঘ তৈরি হয় যার মধ্যে আছে বিখ্যাত ফিশার কিং এবং নাইটস টেম্পলাররা।

অনেক গির্জা এবং যাদুঘর দাবি করে তাদের কাছে আসল হলি গ্রেইল রয়েছে। কিন্তু বিশ্বাস করাটাই মুশকিল হয়ে যায়, আসলে সত্যিকারের হলি গ্রেইল কার কাছে। তবে ড্যান ব্রাউনের “দ্যা ভিঞ্চি কোড” উপন্যাসে দাবি করা হয় উল্লেখিত রোসালিন চ্যাপেলে রক্ষিত তথাকথিত হলি গ্রেইল দেখতে অনেক মানুষ এখানে ভিড় জমায়। ধারণা করা হয়, এই পানপাত্রটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ২০০ অব্দ থেকে খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ১০০ অব্দের মাঝামঝি সময়ে তৈরি করা হয়। হলি গ্রেইল নিয়ে অনেক মানুষের আগ্রহ রয়েছে তবে তা রহস্যময় থেকে গিয়েছে এবং সেই রহস্য কেউ আজ পর্যন্ত উম্মোচন করতে পারেনি।

মধ্যযুগের কবি কিংবা নাইট থেকে শুরু করে আধুনিক ইতিহাসবিদ, প্রত্নতত্ত্ববিদ, ঔপন্যাসিক, চলচ্চিত্র পরিচালক কিংবা নাৎসি নেতা, সবাই ছুটেছেন হলি গ্রেইলের পেছনে। হলি গ্রেইলের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে বিভিন্ন কল্পিত ইতিহাস, আজগুবি তত্ত্ব। তাই বিভিন্ন গুজব আর কল্পকাহিনী থেকে আসল সত্যগুলি আলাদা করে দেখে নেওয়া দরকার, হলি গ্রেইল আসলে কী? যিশুর ব্যবহৃত জিনিস নিয়ে পশ্চিমের ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের আগ্রহ কম নয়। বিভিন্ন ক্যাথলিক গির্জা দাবি করে, তাদের কাছে আছে ক্রুশবিদ্ধ করার পর যিশুর দেহ থেকে খুলে নেওয়া চামড়া, আবার অনেকে দাবি করেন তাদের কাছে ক্রুশবিদ্ধ করার সময় ব্যবহৃত পেরেকগুলিও রয়েছে। হলি গ্রেইল নিয়ে এত মাতামাতি করার কারণ বোধহয় এর আসল আকৃতি, এর অবস্থান কিংবা এর অস্তিত্ব নিয়ে ধোঁয়াশাপূর্ণ ধারণা। খ্রিস্টানদের মধ্যে একটি খুবই জনপ্রিয় বিশ্বাস হলো লাস্ট সাপারের সময় যিশু একে পানপাত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন, এবং যিশু যখন ক্রুশবিদ্ধ হচ্ছিলেন তখন অ্যারিম্যাথিয়ার জোসেফ এই পানপাত্রে যিশুর রক্ত ভরে রেখেছিলেন।

লাস্ট সাপারের সময় ব্যবহৃত এই বিখ্যাত পানপাত্রের উল্লেখ রয়েছে ম্যাথিউ, মার্ক এবং লুকের গসপেলে, যা ইতিহাসবিদদের মতে লেখা হয়েছিল ৮০ থেকে ১০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে। তবে হলি গ্রেইল খ্রিস্টানদের মধ্যে জনপ্রিয় হয় আরো ১ হাজার বছর পর, যখন এর সাথে রাজা আর্থারের গল্পগুলো মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। লিখিত আকারে হলি গ্রেইলের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ফরাসি কবি দ্য ত্রোয়েসের কবিতায়। ১১৮০ এর দশকে লেখা এই অসম্পূর্ণ কবিতায় কবি উল্লেখ করেছেন, পারসিফাল, রাজা আর্থারের একজন নাইট, ফিশার কিংদের (গ্রেইল রক্ষাকারী বিশ্বস্ত গুপ্তসংঘ) আস্তানায় গিয়ে বিভিন্ন গোপন জিনিসের সন্ধান পায়, যার মধ্যে রয়েছে একটি ‘graal’। ১১৯১ থেকে ১২০২ এর মধ্যবর্তী সময়ে আরেক ফরাসি কবি রবার্ট ডি বোরোঁ তার জোসেফ ডি অ্যারিমাথিয়ে কবিতায় উল্লেখ করেছেন ক্রুশবিদ্ধ করার সময় যিশুর রক্ত হলি গ্রেইলে বোতলবন্দী করার ঘটনা। অর্থাৎ জোসেফ হচ্ছে হলি গ্রেইলের প্রথম প্রধান রক্ষাকর্তা।

ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে জার্মান কবি ওলফ্রাম ফন এশেনবাখ তার Parzival কবিতায় তুলে ধরেছেন পারসিভাল নামক এক নাইটের কথা, যে হলি গ্রেইল উদ্ধার করার জন্য এক দুঃসাহসিক অভিযানে নেমেছে। ঐ একই সময়ে ওয়েলসের বিভিন্ন জায়গায় হলি গ্রেইল ও রাজা আর্থারকে নিয়ে বিভিন্ন কাব্যোপন্যাস লেখা হয়, যা পরবর্তীতে স্যার থমাস ম্যালোরি ইংরেজিতে রূপান্তর করেন। তারপর থেকে বিভিন্ন গল্প-উপন্যাসে বারবার উঠে এসেছে এই রহস্যময় জিনিসটির কথা। টেনিসন, স্পিলবার্গ কিংবা ড্যান ব্রাউন, কারও গল্পে কি তাহলে সামান্য সত্যের ছায়া আছে? গুজব রয়েছে, ক্রুসেডের সময় সারাসেন বাহিনী যখন জেরুজালেমে প্রবেশ করে, তখন নাইটস টেম্পলাররা এটি নিয়ে পালানোর সময় হারিয়ে ফেলে। পরবর্তীতে একে কোনোভাবে উদ্ধার করে ব্রিটেনে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে হলি গ্রেইলকে নিয়ে গুজবের অভাব নেই। পৃথিবীজুড়ে কম করে হলেও ২০০টি গির্জা এবং জাদুঘর দাবি করেছে যে তাদের কাছে রয়েছে আসল ‘হলি গ্রেইল’! ড্যান ব্রাউনের ‘দ্য ভিঞ্চি কোড’ উপন্যাসে উল্লেখিত রোসালিন চ্যাপেলে রক্ষিত তথাকথিত ‘হলি গ্রেইল’ দেখতে বছরে প্রায় দেড় লক্ষাধিক মানুষ এখানে ভিড় জমায়

১৯৭৫ সালে তৈরি ‘মন্টি পাইথন অ্যান্ড দ্য হলি গ্রেইল’ ছবিতে দেখা যায় রাজা আর্থারের নাইটরা হলি গ্রেইলের পেছনে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন, আর তাদেরকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে বিভিন্ন বিপদ আর বাধা-বিপত্তি। এর ঠিক ৬ বছর পর ‘এক্সক্যালিবার’ ছবিতে দেখা যায় পারসিফাল হলি গ্রেইল খুঁজে বের করে এবং তা থেকে অসুস্থ রাজা আর্থারকে পান করতে দেয়। ফলে রাজা আর্থার সুস্থ হয়ে ওঠেন। ১৯৮৯ সালে মুক্তি পাওয়া ‘ইন্ডিয়ানা জোনস অ্যান্ড দ্য লাস্ট ক্রুসেড’-এ দেখা যায় হলি গ্রেইলের পেছনে ছোটা নাৎসি বাহিনী আর প্রত্নতত্ত্ববিদ হ্যারিসন ফোর্ডের লড়াই। হলি গ্রেইলের কল্পকাহিনী ব্যবহার করে ছবিটি বক্স অফিস থেকে আয় করেছিল ৪৭৪ মিলিয়ন ডলার!

তবে হলি গ্রেইলকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছেন রহস্য রোমাঞ্চ লেখক ড্যান ব্রাউন। তাঁর লেখা ‘দ্য ভিঞ্চি কোড’ উপন্যাসে হলি গ্রেইলকে নিয়ে লেখা কাহিনীর পুরোটাই কল্পনাপ্রসূত। ব্রাউন দাবি করেছেন, হলি গ্রেইল কোনো পানপাত্র নয়, বরং ম্যারি ম্যাগদালেন নামে একজন নারী। যদিও এই বইটির অনেক উপাদানই এসেছে ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত হওয়া লিন পিকনেটের ‘দ্য টেম্পলার রেভেলেশন’ এবং ১৯৮২ সালে প্রকাশিত হওয়া হেনরি লিংকন ও রিচার্ড লেইয়ের ‘দ্য হলি ব্লাড অ্যান্ড দ্য হলি গ্রেইল’ বই দুটি থেকে। সত্য-মিথ্যা, কল্পনা-বাস্তবতা যা-ই হোক, হলি গ্রেইল মানুষকে যে বিপুলভাবে আগ্রহী করে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
