তপন মল্লিক চৌধুরী
আজদশমী। পাঁচদিনেরদুর্গা পুজোর উৎসব শেষ। শুরু হয়েছে বিজয়া পর্ব। কিন্তু উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জায়গায় নতুন করে শুরু হয়েছে আরেক উৎসব। মূলত জলপাইগুড়ি জেলার কয়েকটি গ্রামে ভান্ডানি দেবীর পুজো ঘিরে হয় এই আঞ্চলিকউৎসব। দশমীতে দুর্গা প্রতিমা বিসর্জন ঘিরে যখন এক স্তব্ধতা নেমেছে তখন জলপাইগুড়ি জেলার রাজবংশী অধ্যুষিত গ্রামগুলিতে নতুন করে আরেক উৎসবের সুচনা। এদিন ময়নাগুড়ি, ধূপগুড়ি, মালবাজার, এমনকি আলিপুরদুয়ার এবং পার্শ্ববর্তী কোচবিহার জেলার বেশ কিছু গ্রামে ভান্ডানি পুজোকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে উৎসব।
অনেক বছর আগে কেবলমাত্র রাজবংশী কৃষকরাই ভান্ডানি পুজোকে ঘিরে এই উৎসবে মেতে উঠতেন, এখন উত্তরবঙ্গের গ্রামাঞ্চলের সব সম্প্রদায়ের মানুষই এতে অংশ নেয়।দুর্গার আরেক রূপভান্ডানি। একাদশী থেকে চারদিন ধরে চলে এই পুজো। দশমীর দিন ‘যাত্রা পুজো’দিয়ে শুরু হয় এই পুজো। শরতের পর হেমন্ত ঋতুতে যাতে চাষাবাদ ঠিকঠাক হয়, ভাল ফসল হয়, তার জন্য কৃষিকাজের প্রয়োজনীয় যন্ত্র- কাস্তে, লাঙল, মই প্রভৃতির পুজো হয় ‘যাত্রা’ পুজোতে। আর তার পরের দিন থেকে শুরু হয় ভাণ্ডানী দেবীর বন্দনা।

ভান্ডানিকে কেউ দেবী দুর্গার অন্য রূপ বলেন, কেউ বলেন বনদুর্গা। উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ বনাঞ্চলের কোথাও কোথাও বনবস্তিবাসীরা ভান্ডানিকে বনদুর্গা রূপে পুজো করে। রাজবংশী সমাজে ভান্ডানিকে নিয়েলোককথায়আছে, বিসর্জনের পর দুর্গা উত্তরবঙ্গের বনাঞ্চল দিয়ে বাপের বাড়ি থেকে কৈলাসে ফেরার পথে রাতের অন্ধকারে পথ হারান। গভীর রাতে জঙ্গলের ভেতর থেকে নারী কন্ঠে কান্নার শব্দ শুনে ছুটে আসে বনবস্তির মানুষ। সেই রাতে তারানিজেদের গ্রামে আশ্রয় দেয় পথ হারিয়ে ফেলা গ্রাম্য বধূটিকে। সেই রাতে দুর্গা ওই গ্রামে কাটিয়ে ফিরে যান কৈলাসে। যাবার আগে অবশ্য তিনি গ্রামবাসীদের নিজের আসল পরিচয় দেন। গ্রামবাসীদের আতিথ্যে সন্তুষ্ট হয়েদুর্গা জানান, উত্তর বাংলার অরণ্যবেষ্টিত গ্রামের মানুষের শস্যের ভান্ডার সারা বছর ভরা থাকবে। সেই থেকেই এখানে দশমীর পর ভান্ডানি পুজো শুরু হয়।
জলপাইগুড়ির ময়নাগুড়ি অঞ্চলের বার্নিশ গ্রামপঞ্চায়েতের ভান্ডারি গ্রামের ভান্ডানি পুজো সবথেকে প্রাচীন। প্রায় পাঁচশো বছর ধরে এই গ্রামে পুজো চলছে। পুজো উপলক্ষ্যে বসে বিরাট মেলা। দুর্গাপুজোর মতো চার দিন চলে ব্যাঘ্রবাহিনী ভান্ডানি পুজো। ভান্ডানি মহিষাসুর মর্দিনী নয়, তিনি দ্বিভুজা।তার বাহন বাঘ, জঙ্গলাকীর্ণবৈকন্ঠপুরে একসময় প্রচুর বাঘ ছিল।কথিত ভান্ডানি সিংহের বদলে বাঘের উপর অধিষ্ঠিতা। সঙ্গে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ থাকলেও অসুর থাকে না।

অন্যদিকে উত্তর দিনাজপুরের হেমতাবাদ ব্লকের কমলাবাড়ি-২ পঞ্চায়েতের খাদিমপুর এলাকার ৭০০টি পরিবারের প্রায় চার হাজার বাসিন্দার সম্মিলিত উদ্যোগে দশমীর রাত থেকে শুরু হয়ে যায় বালাইচণ্ডী পুজো।সমাজের মঙ্গল কামনায় এলাকার বাসিন্দারা বংশ পরম্পরায় প্রাচীন রীতিনীতি, আচার ও নিষ্ঠা মেনে প্রতি বছর বালাইচণ্ডী পুজো করেন।পুজোয় সামিল হনজেলার বিভিন্ন এলাকা সহ বিহার থেকেও প্রচুর মানুষ।বিগত কয়েক বছর খাদিমপুর বারোয়ারি অন্য দুর্গাপুজো নামে সর্বজনীন কমিটি গঠন করে পুজো পরিচালনা করছেন। এলাকাবাসীরা সারা বছর ধরে এই বালাইচন্ডি পুজোর দিকেই তাকিয়ে থাকেন। দশমী থেকে টানা পাঁচদিন বাসিন্দারা নতুন পোশাক পড়ে পুজোর আনন্দে মেতে ওঠেন।
বালাইচণ্ডীর চারটি হাত। অসুর ও মোষ নেই। বালাইচণ্ডীর পাশে লক্ষ্মী, গণেশ, কার্তিক ও সরস্বতী থাকেন। জানা যায় ৩০০ বছর আগে দশমীতে গ্রামে প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রচুর ঘরবাড়ি ও ফসলের ক্ষতি হয়। বহু মানুষ মারা যান। সেই থেকেই সমাজের মঙ্গল কামনায় বাসিন্দারা বালাইচণ্ডী পুজো শুরু করেন। বালাইচণ্ডীপ্রতিমা বিসর্জন না দিয়ে বটগাছের নীচে প্রাচীন মন্দিরে রেখে দেওয়া হয়। প্রতি বছর বিশ্বকর্মা পুজোর পর দিন দেবী বিসর্জনের পরে মৃৎশিল্পীদের প্রতিমার বরাত দেওয়া হয়। বংশপরম্পরায় শিল্পীরা ওই প্রতিমা গড়েন। পুরোহিতরাও বংশ পরম্পরায় পুজো করছেন। পুজো উপলক্ষে এক সপ্তাহ ধরে এই এলাকায় মেলা ও যাত্রার আসর বসে। প্রতি বছর ১০ হাজারের বেশি মানুষের সমাগম হয়।
7 Comments
একটি যথাযথ তথ্যবহুল লেখা, যা পরে সমৃদ্ধ হওয়া যায়।
খুবই ভাল লেখা, অনেকটা জানা ও বোঝা গেল। লেখককে ধন্যবাদ।
একটি সুন্দর ঝরঝরে নিবন্ধ যেখান থেকে অনেক কিছু জানা গেল।
আপনার লেখা মানেই অজানা গল্প, অচেনা জায়গা, এটিও সেরকম একটি। এখন কি এখানে মিলবে নতুন লেখা-
বালাইচণ্ডী নিয়ে আরেকটু যদি লিখতেন তাহলে খুব ভাল হত। তবে একটি নতুন বিষয় জানা গেল। লেখককে অসংখ্য ধন্যবাদ।
ভাণ্ডানী বা বনদুর্গা কি উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সমাজে আগের মতোই সমাদৃত? নাকি তাঁরা মূলস্রোতে মিশে গিয়ে নিজেদের সংস্কৃতি-ঐতিহ্য ভুলতে বসেছে…
জানা ছিল না, তাই পড়ে ফেললুম শিরোনাম দেখেই। এমন অনেক তথ্য ছড়িয়ে আছে, সামনে আনা গেলে উৎসাহী পাঠক উপকৃত হবেন।