ইন্দ্রনীল বসু

অপুর সংসার দিয়ে পথ চলা শুরু। শেষ হলো আজ।

সৌমিত্র, আরো ভালোভাবে বলতে গেলে অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় শুধু বাংলা আর বাঙালির মধ্যে আবদ্ধ নন। তিনি ভারতের এবং সমগ্র বিশ্বে পরিচিত অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে। উত্তম যদি না থাকতেন বাঙালি অবশ্যই সৌমিত্রকেই মহানায়ক উপাধি দিতেন। কোনো তুলনা চলে না দুজনের মধ্যে। কিন্তু তবু চলে আসে।
ঠিক যেমন অমিতাভ বচ্চন আর রাজেশ খান্নার মধ্যে তুলনা হতো একটা সময়। উত্তম আর সৌমিত্রর মধ্যেও তা এসে যায়। উত্তমের মধ্যে ম্যানারিজম ছিল। কিন্তু সৌমিত্র একে বারে সহজ , সরল, সাবলীল। নায়ক থেকে ভিলেন, পড়ার বখাটে ছোঁড়া থেকে গুড বয় – সব চরিত্রে মানিয়ে যাবার মত। তার কারণ একটাই।
নাটকে হাতেখড়ি শিশির কুমার ভাদুরির কাছে। তাকেই অভিনয় জগতের গুরু মানতেন সৌমিত্র। তারপর তো সত্যজিৎ রায়ের একেবারে মানস পুত্র। গ্রুপ থিয়াটারের দিনগুলি থেকেই অজিতেশ বন্দোপাধ্যায়, উৎপল দত্ত, শম্ভু মিত্রর সান্নিধ্য পেয়েছেন। এমন মানুষ সিনেমা জগতে যে অনায়াসে রাজত্ব করবেন তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

নাটক দিয়ে জীবন শুরু সৌমিত্রর। শেষের পর্যায় এসে দাদা সাহেব ফালকে আর অবশ্যই ফরাসি সন্মান লিজিয়ন অফ অনার। তাও নাটক ছারেন নি। মিনারভায় চললো রাজা লিয়ার হই হই করে। নাটকের প্রতি তার ভালোলাগা আর ভালোবাসা তো গল্পকথা। বরাবরই জাত অভিনেতা। নাহলে ক্যারিয়ারের শুরুতেই, শুধু ১৯৬০ সালে কেউ কি চল্লিশটি ছবিতে অভিনয় করার সুযোগ পান ? এর মধ্যে ৭ টি সত্যজিত রায়ের ছবি , তিনটি মৃণাল সেনের ছবি এবং দুটি তপন সিংহর ছবি ছিল। সত্যজিতের তিন কন্যায় তার অভিনয় মুগ্ধ করেছিল শ্যাম বেনেগালকেও। এক সাক্ষাৎকারে শ্যাম বেনগাল বলেছিলেন সৌমিত্রর অভিনয় পার্সিয়ান কার্পেটের মতই সূক্ষ্ম আর অসাধারণ।

একদিকে অজয় করের “সাত পাকে বাঁধা” ( ১৯৬৩) মত ছবিতে একজন শিক্ষকের চরিত্রে অভিনয় আবার অন্যদিকে “বসন্ত বিলাপ” বা তনুজার নায়ক হয়ে “কে তুমি নন্দিনী” গানে সমান সাবলীল ও পারদর্শী সৌমিত্র। সত্যজিতের অরণ্যের দিনরাত্রি ( ১৯৭০) এবং মৃণাল সেনের “আকাশ কুসুম” সবেতেই মানানসই তিনি। আর “জয় বাবা ফেলুনাথ” , ” সোনার কেল্লা ” বা “কোনি”র(১৯৮৬) মত ছবি তো কোনোদিনই ভুলবে না বাঙালি। শেষের দিকে দাদুর চরিত্রে নন্দিতা ও শিবপ্রসাদয়ের “পোস্ত”(২০১৭) ছবিতেও একই ভাবে সহজ ও সাবলীল সৌমিত্র।
কিন্তু এত সবের পরও জাতীয় পুরষ্কার তার ভাগ্যে জোটে নি। সেটা আসে অনেক পরে ২০০৭ সালে তার ” পদক্ষেপ” বলে একটি ছবির জন্য। যা বাংলা সিনেমা মহলের খুব একটা পছন্দ হয়নি। ২০১২ সালে পান দাদা সাহেব ফালকে। এর আগে অবশ্য ২০০৪ সালে পদ্মভুষণ পেয়েছেন। অবশ্য এই সবের সঙ্গে আর একটা শখ ছিল তার কবিতা পড়া ও লেখা। অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে চলত সেই স্বপ্ন পূরণ। তার কণ্ঠস্বর বাঙালির তথা বিশ্ববাসীর কাছে অমর হয়ে থাকবে। অমর হয়ে থাকবে তার অভিনয়।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version