মাদাগাস্কার আফ্রিকার একটি দেশ। ভৌগলিকভাবে গোটা দেশটাই একটি দ্বীপ তবে আয়তন অনেকটাই বড়। এই দেশেরই একটি উৎসবের নাম ‘ফামাদিহানা’। উৎসবটি বড়ই অদ্ভুত। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় মাদাগাস্কার মানুষ মাটির নীচ থেকে পরিবারের আত্মীয়দের মৃতদেহ বের করে নিয়ে আসে, তারপর সেই মৃতদেহ নিয়ে নাচ-গান করতে করতে পুরো এলাকা পরিক্রমা করে।বছর এক আগে থেকেই এই উৎসবের আয়োজন শুরু হয় এবং প্রায় এক সপ্তাহ ধরে চলে নাচ, গান, খাওয়া-দাওয়া। মৃতদেহ কেন্দ্র করে আফ্রিকায় নানা ধরনের লোকাচার প্রচলিত আছে। তবে সবচেয়ে অদ্ভুত লোকাচার মাদাগাস্কারের এই ‘ফামাদিহানা।’সাধারণত মাদাগাস্কারে ফামাদিহানা উৎসব আয়োজিত হয় জুলাই-সেপ্টেম্বর মাসে। কারণ এই সময়ে মাদাগাস্কার দ্বীপে শীত থাকে।বর্ষাকালে বৃষ্টি এবং গ্রীষ্মকালের উষ্ণ আবহাওয়ায় মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে নাচ-গান করা বেশ কষ্টের কাজ।

পরিবারের প্রায় সব সদস্যরাই এই উৎসবের সময় একত্রিত হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, একটি পরিবারের সমস্ত সদস্য মিলিয়ে সংখ্যাটি দু’শো ছাড়িয়ে গিয়েছে। সাত দিন ধরে দুশো মানুষের খাওয়া-দাওয়ার খরচ যথেষ্ঠ ব্যায় বহুল। তাই একটি পরিবার প্রায় বছরখানেক ধরে এই উৎসবের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। সাধারণত, পরিবারের একজন বয়োজ্যৈষ্ঠ সদস্য স্বপ্নের মাধ্যমে পূর্বপুরুষের কাছ থেকে উৎসবের বার্তা পান। স্বপ্নে, মৃত পরিবারের সদস্য নতুন জামাকাপড় চায় কিংবা ঠাণ্ডা লাগছে বলে অভিযোগ করে। পরবর্তীতে যে স্বপ্ন দেখেছে সে জ্যোতিষীর পরামর্শে রাশিচক্র দেখার মাধ্যমে একটি তারিখ নির্বাচন করা হয়। এক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির মৃত্যুবার্ষিকীর উপর ভিত্তি করে তারিখ নির্বাচন করা হয় না। তারিখ ঠিক হয়ে গেলে উৎসব উদযাপনের পরিকল্পনা করা হয় এবং পরিবারের বাকি সদস্যদের আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হয়। নানা জায়গা থেকে পায়ে হেঁটে উৎসবে যোগ দিতে আসেন বাকি সদস্যরা।

মাদাগাস্কার দ্বীপের বেশিরভাগ মানুষ তাদের পরিবারের জন্য দুটি কবর খনন করে। একটি কবরে থাকে শুধু পরিবারের নারী সদস্যদের মৃতদেহ, অপরটিতে থাকে পুরুষ সদস্যদের মৃতদেহ। নারীদের কবরে কখনও পুরুষদের কবর দেওয়া হয় না, একইভাবে পুরুষদের কবরেও নারীদের কবর দেওয়া হয় না। তবে শুধুমাত্র স্বামী-স্ত্রীর ক্ষেত্রে এই নিয়ম শিথিল করা হয়। প্রতিটি পরিবার কবরের জন্য বিশাল অর্থ খরচ করে থাকে। সেই অর্থ এতই বেশি যে, তাদের ঘরবাড়ির থেকেও কবর বেশি ব্যয়বহুল ও জাঁকজমকপূর্ণ হয়ে থাকে। কারণ মাদাগাস্কারে ধরে নেওয়া হয়, যার কবর যত বেশি জাঁকজমকপূর্ণ ও দামী, তার সামাজিক অবস্থান ও অর্থনৈতিক সামর্থ্যও তত উঁচুতে।

ফামাদিহানা উৎসবের সময় কবর থেকে লাশ বা কংকাল তুলে এনে নতুন সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে পাটাতনের উপর রাখা হয়। কবর থেকে লাশ তোলার জন্য যখন কবরের ভেতরে প্রবেশ করা হয়, তখন সবার হাতে মোমবাতি থাকে। পরিবারের সদস্যরা সাধারণত পাটাতন বিভিন্ন প্রান্ত ধরে থাকেন। পাটাতন ও সাদা কাপড়– দুটোকেই সুগন্ধি মাখানো হয়। এরপর শুরু হয় নাচ-গানের পর্ব। আসলে ফামাদিহানা একটি উপলক্ষ্য, এই সময় পরিবারের সদস্য আত্মীয় একত্রিত হতে পারেন। প্রসঙ্গত, আমাদের এই উপমহাদেশে মৃতের সঙ্গে অনেক শোক জড়িয়ে থাকে, যখন কোনো ব্যক্তিকে কবর দেওয়া হয় কিংবা চিতায় পোড়ানো হয়, তখন পরিবেশ দুঃখে ভরে ওঠে, মৃতের আত্মীয়স্বজনেরা অতীতের বিভিন্ন স্মৃতির কথা মনে করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। মাদাগাস্কারে পুরো উল্টো ঘটনা ঘটে। যখন কবর থেকে মৃতের লাশ তুলে আনা হয়, তখন সবাই হাসতে থাকেন। সেখানে মৃত্যু কোনো শোকের বিষয় নয়।

আত্মীয়স্বজন বাদ দিয়ে প্রতিবেশীরাও এই উৎসবে অংশগ্রহণ করেন এবং সৌজন্য হিসেবে আয়োজক পরিবারকে উপহার হিসেবে কিছু অর্থ প্রদান করেন। এই উৎসবের সময় প্রচুর মদ্যপান করা হয়। যারা কবর থেকে লাশ তুলতে নামেন, তাদের হাতেও আফ্রিকান রামের বোতল থাকে। যারা লাশ কাঁধে নিয়ে নাচ-গান করেন, তারাও আগে ইচ্ছে মতো মদ্যপান করেন। লাশ বহন করার জন্য যে পাটাতনটি ব্যবহার করা হয়েছিল, সেটি উৎসবে অংশগ্রহণকারী সবাই স্পর্শ করেন। সবশেষে আয়োজক পরিবার সেটি নিজের বাড়িতে রেখে দেন এই বিশ্বাসে যে, এটি পরিবারের জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনবে।

উৎসবের সময় পরিবারের প্রধান কর্তা পশুও উৎসর্গ করে থাকেন। উৎসর্গীকৃত পশুর মাংস দিয়ে অতিথিদের আপ্যায়ন করার পাশাপাশি বাড়তি মাংস স্থানীয় দরিদ্র মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া হয়। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, আঠারো শতকের পর থেকে এই প্রথা চালু হয়েছে, তবে একেবারে সঠিক সময়ের খোঁজ পাওয়া যায় না কোথাও। ধারণা করা হয়, একটি যুদ্ধের পর নিহত সেনাদের মৃতদেহ দ্বিতীয়বার কবর দেওয়ার ঘটনা থেকেই এই প্রথার প্রচলন ঘটে। ঔপনিবেশিক শাসনামলে যখন খ্রিস্টান মিশনারীদের আগমন ঘটে, তখন তারা এই প্রথার বিরোধিতা করেছিল বটে, কিন্তু স্থানীয় মানুষ কখনও এই প্রথা পালন বন্ধ করেনি। তাই বছরের পর বছর ধরে এই প্রথা চলে আসছে স্রেফ মানুষের বিশ্বাসের উপর ভর করে।