এক নজরে

পদ্মের ধাক্কায় ঝাড়ুর বিদায়   

By admin

February 08, 2025

প্রবীণ গান্ধীবাদী আন্না হাজারের ছত্রচ্ছায়াতেই একদিন অরবিন্দ কেজরিওয়াল একদিন পরিচিতি লাভ করেছিলেন। আন্না হাজারের দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনই কেজরিওয়ালকে দিয়েছিল সেই পরিচিতি। দিল্লিতে ২০১১–১২ সালের সেই আন্দোলন কাঁপিয়ে দিয়েছিল তৎকালীন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারকে। আন্না আন্দোলনের পর রাজনৈতিক দল গড়তে চাননি। কিন্তু অন্য মত ছিল কেজরিওয়ালের। আন্দোলনে শামিল অন্যদের নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছিলেন আম আদমি পার্টি। তাঁর যুক্তি ছিল, সিস্টেম বা ব্যবস্থার মধ্যে থেকে ব্যবস্থার বদল ঘটাতে হবে। তা করতে গিয়ে পরবর্তীতে তিনি নিজেই ব্যবস্থার অঙ্গ হয়ে গেলেন। দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির কাছে হার স্বীকারে বাধ্য হলেন।

আসলে যে দুর্নীতি-বিরোধী স্বচ্ছ ভাবমূর্তিকে হাতিয়ার করে আম আদমি পার্টি দিল্লিতে বাজিমাত করেছিল, সেটাই আপ কম্যান্ডার অরবিন্দ কেজরিওয়ালের পক্ষে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় এবং পতনের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়াল। বস্তুতপক্ষে পরিস্থিতি এমন জায়গায় এসে পৌঁছায় যে একের পর এক হেভিওয়েট আপ নেতারা হেরে গেলেন। জিততে ব্যর্থ হলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়াল, প্রাক্তন উপ-মুখ্যমন্ত্রী তথা শিক্ষামন্ত্রী মণীশ সিসোদিয়া, মন্ত্রী সৌরভ ভরদ্বাজ, দুর্গেশ পাঠকের মতো আপ নেতারা। বিষয়টাকে মোটেও অপ্রত্যাশিত বলছেন না বিশেষঙ্গরা। তাঁদের মত, কেজরিসহ তাঁর দলের নেতাদের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি বেশিদিন ছিল না, দেরিতে হলেও গত পাঁচ বছরে তাতে বারঙ্গবার ধাক্কা লেগেছে। রাজনৈতিক চক্রান্তের শিকার যতই বলা হোক না কেন আবগারি দুর্নীতি মামলায় সিসোদিয়া এবং কেজরিওয়ালের মতো নেতা মন্ত্রীকে জেলে যেতে হয়েছে। এরা দুজনেই আম আদমি পার্টির সবথেকে জনপ্রিয় মুখ, এঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তার জন্য জেল জেতে হলে, যতই রাজনৈতিক চক্রান্তের শিকার দাবি করুন না, জনমানসে দু’জনেরই স্বচ্ছ ভাবমূর্তিতে কালির ছিটে লেগে যাবেই এবং তার ফল পেতে হবেই।

কেজরিওয়ালসহ আম আদমি পার্টির ভাবমূর্তি ধাক্কা খায় শিসমহল বিতর্কেও। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন কেজরিওয়ালের বাসভবন নিয়ে বারংবার কটাক্ষ করেছে বিজেপি। একাধিক রিপোর্ট অনুযায়ী, ক্যাগ-এর তথ্যে উঠে এসেছে যে প্রাথমিকভাবে মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন সংস্কারের জন্য ৭.৯১ কোটি টাকা খরচ হবে বলে ধরা হয়েছিল। শেষপর্যন্ত যখন বরাত দেওয়া হয়, তখন সেই অঙ্ক বেড়ে পৌঁছায় ৮.৬২ কোটি টাকায়। আর কাজ শেষ হলে দেখা যায় যে ৩৩.৬৬ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এর পালটা মোদীকে কটাক্ষ করে ‘রাজমহল’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করতে শুরু করেছিল কেজরি ও তার দল। কিন্তু বিজেপির প্রচারই যে শেষ পর্যন্ত জনমানসে প্রভাব ফেলেছে, সেটা ভোটের ফলাফলেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। কেজরি বা আপের যে ভাবমূর্তির কারণে একদিন যেমন বহু মোদী সমর্থক ২০১৫ এবং ২০২০ সালের দিল্লি বিধানসভা ভোটে কেজরিওয়ালের জন্য ভোট দিয়েছিলেন কিন্তু এবার তাঁরা সেটা আর করেননি। তার মানে আপের ভাবমূর্তি ধাক্কা খেয়েছে যার মধ্যে আবগারি দুর্নীতি এবং শিসমহল বিতর্ক অন্যতম।

অন্যদিকে অরবিন্দ কেজরিওয়াল দীর্ঘদিন ধরেই তাঁর বিরোধীদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলেছিলেন, যার মধ্যে অনেক অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। এমনকি তাঁকে সেই অভিযোগের জন্য অনেকবার ক্ষমাও চাইতে হয়েছে। স্বভাবতই তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। কেজরিওয়াল এরপর অভিযোগ করেন যে হরিয়ানা সরকার দিল্লিতে বিষাক্ত জল সরবরাহ করছে এবং গণহত্যা ঘটাতে চাইছে। এই অভিযোগের পরও বিতর্ক হয়। কিন্তু হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী নায়েব সাইনি দিল্লি সীমান্তে গিয়ে সরাসরি জল পান করে কেজরিওয়ালের দাবি খণ্ডন করেন। রাজনীতিতে এসে কেজরিওয়াল ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি বিলাসবহুল জীবনযাপন করবেন না। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর তিনি সরকারি নিরাপত্তা এবং বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করেছেন। উল্লেখ্য শীশমহল অত্যন্ত ব্যয়বহুল বাসভবন, জনমানসে এর নেতিবাচক প্রভাব যে পড়েছে তা নিয়ে আজ আর সন্দেহ নেই। 

কেজরির বিরুদ্ধে এখনও কোনও দুর্নীতি প্রমাণিত হয়নি। প্রায় সব অভিযুক্তই জামিনে মুক্ত। আদৌ প্রমাণিত হবে কিনা সংশয় রয়েছে। কিন্তু দিল্লিতে আপের হারে বিরাট ফ্যাক্টর আবগারি দুর্নীতির অভিযোগ। কারণ এই দুর্নীতির অভিযোগে মাস ছয়েক জেলে থেকেছেন খোদ অরবিন্দ কেজরিওয়াল, মণীশ সিসোদিয়া থেকে সত্যেন্দ্র জৈনের মতো হেভিওয়েট নেতা। প্রশাসনে এর প্রভাব পড়েছে যেমন তেমনি প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে অরাজকতা, দায়িত্বজ্ঞানহীনতাও চোখে পড়েছে। ক্ষমতায় আসার পর আপ সরকার কিছু প্রতিশ্রুতি পূরণ করলেও বহু কাজ বাকি রয়ে গিয়েছে। তাছাড়া কেজরি খয়রাতির উপর ভরসা করে ভোটে জেতার আশা করেছিলেন। ভোটে জিততে হলে রাস্তাঘাট, পরিকাঠামোগত উন্নয়ন দরকার, সর্বস্তরের মানুষের কাছে উন্নয়নের আলো পৌঁছে দেওয়া দরকার, যেটা আপ সরকার প্রায় ভুলতে বসেছিল। দিল্লির বহু রাস্তাঘাটের বেহাল দশা, নর্দমায় জল জমা, অপরিচ্ছন্ন আবর্জনার স্তূপ এমনকী কেজরির গর্বের সরকারি স্কুল, মহল্লা ক্লিনিকেরও অবস্থা খুব খারাপ। প্রতিবছর শীতকালে দিল্লির বাতাসে বিষ ছড়িয়ে পড়ে। টানা ১০ বছ ক্ষমতায় থেকেও সমস্যার সমাধানে ব্যর্থ কেজরিওয়াল। দিল্লির মধ্যবিত্তরা খাপ্পা হয়ে উঠেছিলেন, তাদের ভোটই শেষে ফ্যাক্টর হয়ে গেল।