বছর তিনেকের ছোট্ট ছেলেআলোকেশ হাতে একটা তবলা পেয়েযেভাবে বাজালো তাতে সবাই অবাক। এরপরই শুরু হয় তাঁর তবলার তালিম।গানের বাড়িতেই আলোকেশ জন্মেছিল। বেড়ে উঠেছিল শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আবহে।তাঁর বাবা অপরেশ লাহিড়ী সেই সময় বাংলা গানের একজন জনপ্রিয় গায়ক। মা বাঁশরী লাহিড়ি ছিলেন শাস্ত্রীয় ঘরাণার গায়িকা। এরকম এক সঙ্গীতের আবহে আলোকেশ লাহিড়ী হয়ে উঠেছিলেন বাপ্পি লাহিড়ী।যে নাম উচ্চারিত হওয়ামাত্র ভেসে ওঠে বিশাল আলখাল্লা ধাঁচের জমকালো পোশাক তার সঙ্গেগা ভরা ঝলমলে সোনার গয়নার আর একমুখ হাসি। এখানেই থেমে যাওয়া যায়না, অবশ্যই বলতে হয় বলিউডে কয়েক দশক ধরে রাজত্ব করেছেন সুরে আর গানে যেখান থেকে উঠে এসেছে একের পর এক জনপ্রিয় গান।
শুরু করেছিলেন বাংলা ছবি ‘দাদু’-তে। সেটা ১৯৭২ সালের কথা। বাপ্পির তখন ১৯ বছর বয়স।এরপর বাপ্পি পাড়ি দেন মুম্বাইতে।কিশোর কুমার এবং এস. মুখার্জী ছিলেন সম্পর্কে তাঁর মামা।১৯৭৩ সালে বাপ্পি বলিউডে নাম লেখালেন হিন্দি ভাষার ছবি ‘নানহা শিকারী’তে, কিন্তু প্রথম ছবিতে তিনি লিখেছিলেন গান। এরপর তাহির হুসেনের ছবি ‘জখমী’, সেখানেও তাঁকে গীতিকার হিসাবে কাজ করেন এবং গান গেয়েছিলেন মোহাম্মদ রফি এবং কিশোর কুমারের সঙ্গে। তার পরের ছবি ‘চলতে চলতে’ (১৯৭৬), এই ছবির গানে সুর করলেন বাপ্পি সঙ্গে গানও গাইলেন।এই ছবিটির গানও দর্শক-শ্রোতাদের কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

এরপর বাপ্পিকে আর পিছনে তাকাতে হয়নি। একে একে তার সুর ও গান হিট করে সুরক্ষা; ওয়ারদাত; আরমান; কমাণ্ডো; ইলজাম; পিয়ারা দুশমন; ডিস্কো ড্যান্সার; ড্যান্স ড্যান্স; ফিল্ম হি ফিল্ম; সাহেব; টারজান; কসম পয়দা করনে ওয়ালে কি; ওয়ান্টেড: ডেড অর এলাইভ; গুরু; জ্যোতি; নমক হালাল; শরাবী ইত্যাদি। ১৯৮৫ সালে বাপ্পি ফিল্মফেয়ার সেরা সঙ্গীত পরিচালকের পুরস্কার পেলেন।মুম্বাইতে তিনি সাম্রাজ্য বিস্তার করলেন এইতবার; জিন্দাগী এক জুয়া; হিম্মতওয়ালা; জাস্টিস চৌধুরী; নিপ্পু রাব্বা; রোদী ইন্সপেক্টর; সিমহাসনম; গ্যাং লিডার; রৌদী অল্লাদু; ব্রহ্মা; হাম তুমহারে হ্যায় সনম; জখমী প্রভৃতি ছবিতে। এছাড়াও বাপ্পির মনে রাখার মতো কাজ মালায়ালম ছবি কেরা দ্য গুড বয়েজ ছবির জন্য সঙ্গীত পরিচালনা।

‘আই এম এ ডিস্কো ড্যান্সার…’ বাপ্পি লাহিড়ীর নিজের সুরে ডিসকো ডান্সার ছবির এই গান দুর্গাপুজো-সহ বহু অনুষ্ঠানে এখনো বাজে। আর তার সঙ্গে মিঠুন চক্রবর্তীর নাচের স্টেপ। দুই বাঙালি কিভাবে বলিউড কাঁপাতে পারে, এই গানটা ছিল তারই নজির। ১৯৮০’র দশকে বেশ কিছু ছবিতে জুটি বেধেছিলেন মিঠুন চক্রবর্তী এবং বাপ্পী লাহিড়ী একসঙ্গে।এভাবেই বাপ্পি হয়ে উঠেছিলেন ‘ডিস্কো কিং’।
ডিসকো কিং বাপ্পি নিজেকে আলাদা করতে সবসময় অনেকগুলো গয়না পরে থাকতেন। গলায় মোটা সোনার চেন থেকে শুরু করেব্রেসলেট, আংটিতে ভরে রাখতেন তাঁর শরীর।অনেকের মধ্যে থেকেও তিনি নজর কাড়তেন। এজন্য তাঁকে বলা হত বলিউডের ‘গোল্ডেন ম্যান’। কিন্তু বাপ্পি কেন এত গয়না পরতেন? আসলে এ ব্যাপারে তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল এলভিস প্রেসলি।বাপ্পী লাহিড়ী বলেছিলেন, আমেরিকান পর সিঙ্গার এলভিস প্রেসলি সোনার হার পরতেন। তিনি ছিলেন এলভিস প্রেসলির বড় ভক্ত। বাপ্পি ভাবতেন, তিনি যদি কোনো দিন সফল হন, তাহলে নিজের অন্যরকম ভাবমূর্তি গড়ে তুলবেন। বাপ্পির বিশ্বাস ছিল তিনি সেটা করতে পেরেছিলেন। সোনা বাপ্পির জন্য ছিল খুব লাকি, তাঁর এগিয়ে যাওয়ার সাহস।


তবে বাপ্পিকে মুম্বাইতে প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেছিলেন কিশোর কুমার।বাংলা ও হিন্দিতে কিশোর কুমার-বাপ্পি লাহিড়ী জুটিও বিশেষ জনপ্রিয় ছিল। এই জুটি বলিউডকে উপহার দিয়েছেন অনেক স্মরণীয় গান। কেবল বলিউড নয়, টলিউডও তাঁর সুরের জাদুতে মুখরিত হয়েছিল। বাপ্পি লাহিড়ী ভারতীয় ধাঁচে ডিস্কোর সুরকে জনপ্রিয় করেছিলেন। তাঁর সুররচিত গানগুলো কিশোর কুমার এবং আশা ভোঁসলে’র নেপথ্য কণ্ঠে চলচ্চিত্রের পর্দায় উদ্ভাসিত হয়েছে। বাপ্পি লাহিড়ীর নিজের কথায়, কুড়ি বছর বয়সে তিনি একটি কমেডি ছবি ‘বদতি কা নাম দাড়ি’তে কাজ করেছিলেন। ওই ছবিতে বাপ্পি একটি ছোট চরিত্রে অভিনয়ও করেন। কিশোর কুমারই তাঁকে হিন্দি ছবিতে সুরকার হিসাবে কাজ করতে বলেছিলেন। তাতে বাপ্পি তাঁর হিন্দি ভাল বলতে না পারার কথা জানালে কিশোর কুমার সাহস জুগিয়েছিলেন।
বলিউডে 'ডিসকো ডান্সার'-এর গান সুপার হিট করে। বিরাট লাভের মুখ দেখে প্রযোজক। বাপ্পির এই সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে বলিউডে অনেকেই বাপ্পীকে নানা ভাবে বয়কট করে। এরপর হিন্দি ছবিতে তাঁর কাজ পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়। এই খারাপ সময়ে একমাত্র কিশোর কুমার তাঁর পাশে ছিলেন, তাঁর সুরে গান গেয়েছিলেন। কিশোর কুমারের মৃত্যুতে বাপ্পি এতটাই আঘাত পেয়েছিলেন যে, গান ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। তবে শেষপর্যন্ত সুরের মোহজাল থেকে তিনি বেরোতে পারেনি।
2 Comments
একদা বাঙালিরাই মুম্বাইতে রাজত্ব করতো, তাঁরাই বলিউডকে একটা ভিন্ন মাত্রা দিয়েছিলেন, ধীরে ধীরে সেটা ক্ষয় হয়, তারপরও যেটুকু ছিল সেখানেও বাপ্পি লাহিড়ি, মিঠুন চক্রবর্তী
প্রমুখ সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন, এরপর আর কাউকে সেভাবে খুজে পাওয়া যায় না।
যে সময়ে বাপ্পি লাহিড়ী বাংলা থেকে মুম্বাই গিয়ে নিজেকে প্লেব্যাক সিঙ্গার এবং হিন্দি সিনেমার গানের সুরকার হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন সেটা খুব কঠিন সময়।
কিশোর কুমার তাঁকে সাহায্য করেছিলেন ঠিকই কিন্তু গানের সুরে অন্য ছোঁয়া আনতে হয়েছিল, তা না হলে সম্ভব হত না।